কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বজুড়ে যে গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে, তা নিরসনের জন্য বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বাড়াতে সহায়ক কর্মকাণ্ড কমানো ও পরিত্যাগ করার প্রয়াস ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। জীবাশ্ম জ্বালানিগুলোর মধ্যে সর্বাধিক পরিবেশদূষণকারী হচ্ছে খনিজ কয়লা, যা বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে এখন পৃথিবীর অনেকে দেশেই কয়লার ওপর নির্ভরতা কমানোর জোর প্রচেষ্টা চলছে। ইউরোপের অধিকাংশ দেশ ধাপে ধাপে কয়লা ব্যবহার থেকে সরে আসছে। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে যুক্তরাজ্য ও জার্মানির কথা। যুক্তরাজ্য ২০১৫ সালে ঘোষণা করেছে, ২০২৫ সালের মধ্যে দেশকে পুরোপুরি কয়লামুক্ত করবে। জার্মানি ২০৩৮ সালের মধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণভাবে বেরিয়ে আসার পরিকল্পনা করেছে এবং ধাপে ধাপে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে চলতি বছরের জুলাই মাসে জার্মান পার্লামেন্ট একটি ‘কোল এক্সিট ল’ পাস করেছে।

কয়লাবিরোধী এ বৈশ্বিক প্রবণতার বিপরীতে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে কয়লার ওপর নির্ভরশীলতাই এতকাল লক্ষণীয় ছিল। সেই নির্ভরতার মানসিকতা থেকেই সরকার এ পর্যন্ত ২১টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দিয়েছে। অথচ বাংলাদেশ এতটা কয়লাসমৃদ্ধ দেশ নয় যে এতগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি হিসেবে কয়লার সরবরাহ আমরা নিজেরাই করতে পারি। বরং আমাদের কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সিংহভাগ চালানোর জন্য বিদেশ থেকে কয়লা আমদানি করতে হবে। সুন্দরবনের অদূরে রামপালে নির্মীয়মাণ যে বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে এ দেশে প্রবল জনমত রয়েছে, সেটিরও জ্বালানি কয়লা এবং প্রধানত সেটাই এর বিরোধিতার কারণ।

তবে সম্প্রতি প্রকাশিত এক খবরে জানা গেল, জ্বালানি হিসেবে কয়লার ব্যবহার সম্পর্কে সরকারের চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন ঘটেছে। বিদ্যুৎ বিভাগের বরাত দিয়ে গত ২৭ অক্টোবর প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যে ২১টি কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ৫টি রেখে বাকি ১৬টির অনুমোদন বাতিল করার চিন্তাভাবনা চলছে। অবশ্য ভাবনার এ পরিবর্তনের প্রধান কারণ পরিবেশ সুরক্ষা নয়; বরং এগুলো নির্মাণের ক্ষেত্রে কতকগুলো বাস্তবিক সমস্যা, বিশেষত অর্থায়নের সমস্যা। তা ছাড়া অনুমতিপ্রাপ্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর অধিকাংশই যথাসময়ে নির্মাণকাজ শুরুই করতে পারেনি। তার চেয়েও বড় কথা, দেশের মোট চাহিদার তুলনায় মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল বেশি। এখনই উৎপাদনক্ষমতার তুলনায় মোট সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ চাহিদা প্রায় অর্ধেক কম এবং নির্মিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে ভর্তুকি গুনতে হচ্ছে। এসব বিবেচনাই পরিবর্তিত চিন্তাভাবনার কারণ বলে জানা গেছে।

আমরা মনে করি, এসব বিবেচনা অবশ্যই বাস্তবসম্মত। তবে কয়লার ব্যবহার কমানো এবং চূড়ান্তভাবে বন্ধ করার পথে আমাদের অগ্রসর হওয়া উচিত বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশদূষণের বিষয়টিকে মনোযোগের কেন্দ্রে রেখে। বিশ্বজুড়ে সবাই সেই চেষ্টাই করছে। কয়লা ও অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার ধাপে ধাপে কমিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে বিশ্বকে মানুষের বসবাসের উপযোগী রাখার স্বার্থে। সে জন্য গ্রিনহাউস গ্যাস সৃষ্টিকারী জ্বালানির পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের ওপরই সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করতে হবে। সুখের বিষয়, বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে উৎসাহব্যঞ্জক সাফল্য অর্জন করেছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি, বিশেষত অফ গ্রিড সোলার সলিউশনে বাংলাদেশের সাফল্য বেশ উল্লেখযোগ্য। ‘রিনিউয়েবলস ২০২০ গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্ট’ অনুযায়ী, অফ-গ্রিড সৌরপদ্ধতি থেকে অতিরিক্ত ১১ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে নেপালের অবস্থান প্রথম। আর বাংলাদেশ ও মঙ্গোলিয়া এ পদ্ধতিতে ৮ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে যৌথভাবে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ এখন ৬৩০ দশমিক ৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। এর মধ্যে ৩৯৭ দশমিক শূন্য ৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসে সৌরশক্তি থেকে। আমাদের সৌরশক্তিসহ নবায়নযোগ্য অন্যান্য জ্বালানির দিকেই আরও জোর দিতে হবে।