খুলনার সমাবেশ–কাণ্ড

সম্পাদকীয়

গণতান্ত্রিক দেশে সভা-সমাবেশ করার অধিকার নাগরিকদের আছে। তবে সেই সমাবেশের নামে অন্যের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করা যাবে না। এ কারণে রাজনৈতিক দল বা সংগঠনগুলো তাদের কর্মসূচি আগাম জানিয়ে দেয়, যাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সাধারণ মানুষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে।

কিন্তু গত শনিবার খুলনায় বিএনপি আহূত মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে পুলিশ প্রশাসন ও সরকার-সমর্থক পরিবহনমালিক যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা কেবল জনমনে উদ্বেগ বাড়িয়ে দেয়নি; বহু মানুষকে মহাদুর্ভোগের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। খুলনার পরিবহন বাস মালিক সমিতি শুক্রবার থেকে শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত খুলনা থেকে ১৮টি রুটে বাস চলাচল বন্ধ করে দেয়। ফলে নগরবাসীর জন্য এক অসহনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে যারা দূরযাত্রার যাত্রী, তারা চরম ভোগান্তিতে পড়ে।

পরিবহনমালিকদের দাবি, খুলনায় বিএনপির সমাবেশে কোনো গোলমাল হতে পারে, এ কারণে নাকি পরিবহনশ্রমিকেরা বাস চালাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। বিএনপি শহীদ হাদিস পার্কে সমাবেশ করার অনুমতি চেয়েছিল। কেএমপি সেখানে সমাবেশের অনুমতি না দেওয়ায় বিএনপির নেতা-কর্মীরা দলীয় অফিসের সামনে জড়ো হন। কিন্তু সেই জায়গাটিও পুলিশ চারদিকে দিয়ে ঘিরে ফেলে। সকাল ১০টার পর কাউকে সেখানে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, বিএনপি অফিসের সামনে নেতা-কর্মী-সমর্থক ছিলেন দুই হাজারের মতো। তাঁদের পাহারায় সমসংখ্যক পুলিশ সদস্য ছিলেন। শেষ পর্যন্ত পুলিশের বেষ্টনীর মধ্যে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের নিয়েই সমাবেশ হয়েছে এবং কোনো গোলযোগ হয়নি।

সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বলছেন, বিএনপি জনবিচ্ছিন্ন দল; রাজপথে আন্দোলন করার সামর্থ্য তাদের নেই। তাই যদি না থাকে, তাহলে বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে গোটা খুলনা শহরকে পুলিশ দিয়ে ঘিরে ফেলা হলো কেন? বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধা নিষেধ-সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণ ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’

বিএনপির সমাবেশ বন্ধ করতে ক্ষমতাসীনেরা এখন যেসব যুক্তি দেখাচ্ছেন, ক্ষমতায় থাকতে বিএনপিও একই রকম যুক্তি দিয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশ বন্ধ করেছে। গণতন্ত্রের নামে এই প্রহসন চলতে পারে না। সরকার জনগণের শান্তি বজায় রাখতে যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তাতে অশান্তি আরও বেড়েছে। বিএনপি যাতে নির্বিঘ্নে সমাবেশ করতে পারে, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। তা নিশ্চিত করা গেলে জনদুর্ভোগের মাত্রাও কমানো যেত। অন্তত দূরবর্তী যাত্রীদের এতটা ভোগান্তিতে পড়তে হতো না। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা যেহেতু বিএনপিকে বর্তমানে ‘গণবিচ্ছিন্ন’ একটি দল হিসেবে বিবেচনা করেন, সেই দলটির সমাবেশ নিয়ে কেন সরকার এত বিচলিত?

এদিকে গতকাল রোববার ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ছাত্রদলের সমাবেশকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও ছাত্রদল নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ হয়েছে। এতে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। ছাত্রদলের পক্ষ থেকে বলা হয়, পুলিশ তাদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ পণ্ড করতে হামলা চালিয়েছে। পুলিশ বলেছে, তাদের ওপর ছাত্রদলের কর্মীরা ইটপাটকেল ছুড়েছেন। কোনো সমাবেশ বা কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে পরিবহন বন্ধ কিংবা সংঘাত চলতে পারে না। জনশৃঙ্খলার দোহাই দিয়ে কথায় কথায় বিরোধী দলের সমাবেশ বন্ধ করার এ সংস্কৃতি সরকারকে পরিহার করতে হবে।