চমকহীন বাজেট

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের যে বাজেট ঘোষণা করেছেন, তাতে চমক বা নতুনত্ব নেই। ফি বছরের মতো এবারও তিনি একটি ঘাটতি বাজেট দিয়েছেন। অর্থমন্ত্রীর এই বাজেটে একটি চমকই আছে, আর তা হলো বেসরকারি ব্যাংকের মালিকদের তুষ্ট করতে করপোরেট কর কমানো। তুলনায় শিল্পোদ্যোক্তাদের জন্য তেমন প্রণোদনা নেই এ বাজেটে। নেই কর্মসংস্থার বাড়ানোরও কোনো ইঙ্গিত। বাজেটে করের হ্রাস বৃদ্ধির যে হিসাব তুলে ধরা হয়েছে, তাতে উচ্চবিত্তের চেয়ে মধ্যবিত্তই বেশি চাপে পড়বে। সভা-সেমিনারে ব্যাংকিং খাত ও শেয়ারবাজারের অব্যবস্থা নিয়ে অর্থমন্ত্রী জোরালো বক্তব্য রাখলেও বাজেট বক্তৃতায় তার ছাপ নেই। শুধু বলেছেন, কয়েকটি ব্যাংকে কিছু অব্যবস্থাপনা থাকলেও সময়মতো পদক্ষেপ নেওয়ায় সেটি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে। অথচ বর্তমান সরকারের বেশির ভাগ সময়ই ব্যাংকিং খাতের অস্থিরতা ও কেলেঙ্কারিতে ছিল টালমাটাল।

২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটের আকার ধরা ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা ধরা হলেও ঘাটতি রয়েছে ১ লাখ ২১ হাজার ২৪২ কোটি টাকা। অন্যদিকে আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৪৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। বাজেটে অনুন্নত খাতে যে ২ লাখ ৫১ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে, তা থেকে এক পয়সাও কমানো যাবে না। কিন্তু আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হলে উন্নয়ন খাতের ১ লাখ ৭৯ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকার বরাদ্দ থেকে কাটছাঁট করতে হবে। বাজেট বাস্তবায়নই যে কঠিন সে কথা অর্থমন্ত্রীও স্বীকার করেছেন। উন্নয়ন প্রকল্পগুলো যথাসময়ে বাস্তবায়িত না হওয়ায় তিনি আমলাদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশও করেছেন। কিন্তু তাঁর বক্তৃতায় বাজেট বাস্তবায়নের কোনো দিকনির্দেশিকা পাওয়া গেল না। এটা হতাশাজনক।

অনেকের মতে, এবারের বাজেট নির্বাচনী বা জনতুষ্টির বাজেট। কিন্তু সেই জনতুষ্টি যদি হয় দলীয় লোকজনকে কিছু সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থাপত্র, তা গ্রহণযোগ্য নয়। বাজেটে রাজস্ব আদায়, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। তবে ধনীদের সম্পদের ওপর সারচার্জ বাড়ানো, স্থানীয় শিল্পের প্রসারে নীতিসহায়তা, প্রতিবন্ধীবান্ধব হাসপাতালের সুবিধা, গরিবের রুটি-বিস্কুট ও পাদুকার ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) তুলে নেওয়া ইতিবাচক বলেই আমরা মনে করি।

তবে উদ্বেগজনক হলো, জিডিপির মাত্র সোয়া ২ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় হচ্ছে, স্বাস্থ্য খাতে মাত্র শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ। অথচ স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে জিডিপির ৪-৫ শতাংশ ব্যয় হওয়া উচিত। বাড়ানো প্রয়োজন সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ও। আগের বাজেটগুলোতে অর্থমন্ত্রী আঞ্চলিক বৈষম্যের বিষয়ে বেশ সোচ্চার থাকলেও এবার তার প্রতিফলন নেই। বহুল আলোচিত ব্যাংক কমিশনের মতো আরও অনেক কিছু তিনি ভবিষ্যৎ সরকারের হাতে রেখে গেছেন। কিন্তু সেই ভবিষ্যৎ সরকারের নীতি–পরিকল্পনা কতটা বর্তমানের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ, তার ওপরই নির্ভর করছে বাজেট বাস্তবায়ন।

বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান বলেছেন, অনলাইন কেনাকাটায় কর নেই, বক্তৃতায় ভুল ছাপা
হয়ে থাকতে পারে। তাঁর এই মন্তব্য দুঃখজনক এ কারণে যে বাজেট প্রণয়নের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কতটা হেলাফেলার বিষয় ভাবেন।

বাজেটে নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিক্রিয়া এসেছে। সংসদের ভেতরে–বাইরেও আরও আলোচনা হবে। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, অর্থমন্ত্রী সেসব আমলে নিয়ে বাজেট চূড়ান্ত করবেন, যাতে বৃহত্তর মানুষের কল্যাণ ও স্বার্থ সুরক্ষিত হয়।

টানা দশমবারের মতো বাজেট পেশ করার জন্য অর্থমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই।