চাল আমদানিতে দ্বিতীয়

সম্পাদকীয়

যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) চলতি মাসের ‘খাদ্যশস্য: বিশ্ববাজার ও বাণিজ্য’ শীর্ষক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে গত সোমবার প্রথম আলোর খবরে বলা হয়, ২০২০-২১ বাণিজ্য বছরে বাংলাদেশ ২৬ লাখ ৫০ হাজার টন চাল আমদানি করেছে, যা চাল আমদানিকারক দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ৪৫ লাখ টন আমদানি করে প্রথম স্থানে আছে চীন। তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম অবস্থানে আছে যথাক্রমে ফিলিপাইন, নাইজেরিয়া ও সৌদি আরব। বাণিজ্য বছর হিসাব করা হয় প্রতিবেদন প্রকাশের আগের ১২ মাস ধরে।

যেখানে সরকার অনেক বছর ধরে খাদ্যশস্য, বিশেষ করে ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ দাবি করে আসছে, সেখানে চাল আমদানির এই পরিসংখ্যান খুবই হতাশাজনক। গেল দশকের শুরুতে কয়েক বছর দেশে উৎপাদিত ধান মোটামুটি চাহিদা মেটাতে পারলেও ২০১৩ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে আমাদের চাল আমদানি করতে হচ্ছে। যে বছর ধান উৎপাদন কম হয়, সে বছর চাল আমদানির পরিমাণ আরও বেড়ে যায়। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে বাংলাদেশে চালের দাম যে বেশি, তার পেছনেও আছে নানা কারসাজি।

কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক চাল আমদানির যুক্তি দেখিয়ে বলেছেন, দেশে মানুষের আয় বাড়ছে। ফলে ভাতসহ অন্য সব ধরনের খাদ্য গ্রহণ বাড়ছে। হাঁস-মুরগি, গবাদিপশুর খাবারসহ বিভিন্ন খাতে চালের চাহিদা বাড়ছে। তাঁর ভাষ্য, প্রতিবছর ধান উৎপাদন বাড়ছে, কিন্তু সেই বর্ধিত উৎপাদন কি বর্ধিত জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে পারছে? যদি পারত, তাহলে বিপুল পরিমাণ চাল আমদানি করতে হতো না। চালের সঙ্গে ৭২ লাখ টন গম আমদানির হিসাব ধরলে প্রধান খাদ্যশস্য আমদানির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় এক কোটি টন।

সে ক্ষেত্রে খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দাবি বাগাড়ম্বর ছাড়া কিছু নয়। প্রকৃতপক্ষে, দেশে যে পরিমাণ ধানের উৎপাদন বাড়ছে, চাহিদা বাড়ছে তার চেয়ে অনেক বেশি। সর্বশেষ জনশুমারি হয়েছে ২০১১ সালে; ১০ বছর আগে। এই ১০ বছরে কত জনসংখ্যা বেড়েছে, সে সম্পর্কেও সঠিক তথ্য সরকারের কাছে নেই। জনসংখ্যার সঠিক হিসাব না থাকলে চাহিদা নিরূপণ করা কঠিন। কৃষিমন্ত্রী নিজেও স্বীকার করেছেন, জনশুমারি করে দেশের বর্তমান জনসংখ্যারও একটি সর্বজনগ্রাহ্য হিসাব তৈরি করা প্রয়োজন।

মনে রাখতে হবে, আমাদের কৃষিজমি ক্রমেই কমে যাচ্ছে। আবার যে পরিমাণ কৃষিজমি আছে, সেখানেও কৃষকেরা ধান চাষ বাদ দিয়ে ফল ও মাছ চাষের দিকে ঝুঁকছেন। লবণাক্ততার কারণে দক্ষিণাঞ্চলের ১০ লাখ হেক্টর জমিতে একটির বেশি ফসল ফলানো যায় না। সেখানে লবণসহিষ্ণু ধান উৎপাদনের যে উদ্যোগ ছিল, তা-ও খুব ফলপ্রসূ হয়নি। আমাদের দেশে ধানের উৎপাদন বাড়লেও জাপান, চীন ও থাইল্যান্ড থেকে অনেক কম। বাংলাদেশে প্রতি একর জমিতে ধান উৎপাদন হয় ৬-৭ টন। জাপানে ২৬-২৭ টন। উৎপাদন বাড়াতে হলে বিআর-২৮ ও বিআর-২৯-এর ওপর নির্ভর না করে উচ্চফলনশীল নতুন নতুন জাতের ধান উদ্ভাবনের বিকল্প নেই।

সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে একটি প্রবণতা আছে যে অধিক জনসংখ্যা দেশের সম্পদ। এ কারণে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে একধরনের শিথিলতা দেখানো হচ্ছে। তাঁদের সেই ধারণা যে ভুল, তার প্রমাণ খাদ্যশস্য উৎপাদনে ‘সফল সরকারের’ আমলেও বছরে ২৬ লাখ টনের বেশি চাল আমদানি করতে হচ্ছে। অতএব, খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সরকারকে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে।