চাল-গমের বদলে টাকা

সম্পাদকীয়

টেস্ট রিলিফ এবং কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিতে চাল ও গমের পরিবর্তে সরকার নগদ টাকা দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার নানা মাত্রা আছে। প্রথমত, সরকার সিদ্ধান্তটি নিয়েছে অনেকটা নিরুপায় হয়ে। সরকারি খাদ্যের মজুত কমে যাওয়া এবং খাদ্যশস্য ক্রয়ে ধীরগতির কারণে একটা ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এই কর্মসূচিতে আরও বেশি পরিমাণ চাল কম বরাদ্দ করা হলে সেই ঝুঁকি আরও বাড়বে।

উল্লেখ্য, দরিদ্রদের জন্য অস্থায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে সরকার শ্রমিকদের মজুরি হিসেবে তিন লাখ থেকে চার লাখ টন চাল ও গম দিয়ে থাকে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এই খাতে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

গত বোরো মৌসুম ও চলতি আমন মৌসুমে খাদ্যশস্য মজুতের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ এবং কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় চাল ও ধান সংগ্রহ করতে না পারায় সরকারি গুদামে খাদ্যশস্যের মজুত কমে গেছে। গত বছরের জুলাই মাসে সরকারের কাছে ১১ লাখ ৮৮ হাজার টন চাল মজুত ছিল, যা গত মাসে কমে দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৪৭ হাজার টনে। ২০১৯ সালের জুনে খাদ্য বিভাগের মজুত ছিল ১৬ লাখ ৭৪ হাজার টন খাদ্যশস্য।

মজুতের এই পরিস্থিতিকে কোনোভাবে ঝুঁকিমুক্ত বলা যায় না। এ অবস্থায় কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিতে আরও খাদ্য বরাদ্দ দিলে ঝুঁকি বাড়ত। সেদিক থেকে মজুরি হিসেবে চাল-গমের বদলে নগদ টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক বলে মনে করি।

একই সঙ্গে আমাদের এ কথাও বলতে হবে যে খাদ্যশস্য সংগ্রহের বিষয়ে সরকারের আরও উদ্যোগী ভূমিকা নেওয়া প্রয়োজন। সরকার বাস্তবতার নিরিখে সংগ্রহের যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে, তা কেন পূরণ হয় না। এর পেছনে কাদের গাফিলতি আছে, তা-ও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। সরকারি পর্যায়ে খাদ্যশস্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হলে প্রান্তিক কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। আর লাভবান হন চালকলের মালিক ও ফড়িয়ারা। সরকার কৃষকদের কাছ থেকে ধান না কিনলে কৃষকেরা চালকলের মালিকদের কাছে কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন। চাল মজুত রাখার কোনো ব্যবস্থা তাঁদের নেই। ভারতসহ অনেক দেশেই সমবায় পদ্ধতিতে কৃষকেরা ধান-চাল মজুত করে থাকেন। সেদিকেও আমাদের নজর দেওয়া প্রয়োজন।

খাদ্যসচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম যদিও বলেছেন, মজুরি হিসেবে চাল-গমের বদলে টাকা দেওয়ার এই ব্যবস্থা কেবল চলতি বছরের জন্য, আগামী বছর আবার খাদ্যশস্য দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, কাজের বিনিময়ে খাদ্যশস্যের চেয়ে নগদ টাকা দেওয়া লাভজনক। প্রথমত, খাদ্যশস্যের জন্য বাড়তি লোকবল, অবকাঠামো ও পরিবহন ব্যয় দরকার হয়। নগদ টাকা দিলে এসব খরচ বাঁচবে এবং গরিবের হকের ওপর স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ভাগ বসানোর শঙ্কাও কম। নগদ টাকা বিকাশ বা নগদের মাধ্যমে সরকারি মজুরি শ্রমিকের কাছে চলে যাবে। কৃষির ভর্তুকি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে কৃষক পেতে পারলে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির টাকা কেন শ্রমিক পাবেন না?

আমরা সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। তবে এই কর্মসূচিতে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে, তা যাতে গরিব শ্রমিকেরা যথাযথভাবে পান, সে বিষয়ে সার্বক্ষণিক নজরদারি জারি রাখতে হবে।