চালের মূল্যবৃদ্ধি

সম্পাদকীয়

বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য চালের বাজারে অস্থিরতা শুরু হলে বিপুলসংখ্যক দরিদ্র, নিম্নবিত্ত, এমনকি মধ্যবিত্ত শ্রেণির পরিবারগুলোর ওপরও আর্থিক চাপ বাড়তে শুরু করে। এবার তা শুরু হয়েছে অসময়ে এবং প্রত্যাশার বিপরীতে। চালের দাম বাড়তে শুরু করার স্বাভাবিক সময় এটা নয়। কারণ, সবে আমন মৌসুমের ধান উঠছে। সাধারণত বছরের এই সময়ে চালের দাম কিছুটা হলেও কমে। কিন্তু এবার তার উল্টো প্রবণতা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। খোদ সরকারি সংস্থা টিসিবির বাজারদরের তালিকাতেই দেখা যাচ্ছে, গত বছরের এই সময়ের তুলনায় বিভিন্ন জাতের চালের দাম এখন ১৭ থেকে ৪৮ শতাংশ বেশি। এটা অস্বাভাবিক ও উদ্বেগজনক। কারণ, কোভিড-১৯ মহামারি অব্যাহত; বিপুলসংখ্যক মানুষের আয়-রোজগারের পথ বন্ধ হয়েছে কিংবা গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

কিন্তু এই ভরা আমন মৌসুমে চালের দাম এমন অস্বাভাবিক হারে বাড়তে শুরু করার কারণ কী? আমাদের দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতা হলো সরকারি গুদামে চালের মজুত যখন বেশ কমে যায়, তখন বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাবে চালের দাম বাড়ে। এ বছর খাদ্য মন্ত্রণালয় বোরো মৌসুমে ধান-চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি; আমন মৌসুমে দুই লাখ টন ধান ও ছয় লাখ টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে। কিন্তু এ পর্যন্ত সংগ্রহ করতে পেরেছে মাত্র ১৩ হাজার টন চাল। সরকারি গুদামে এখন চালের মজুত আছে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টন; এই পরিমাণ খুবই কম। গত বছর এই সময়ে সরকারি মজুতের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ টনের বেশি।

প্রশ্ন হলো, খাদ্য অধিদপ্তর ধান–চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে এতটা ব্যর্থ হচ্ছে কেন? প্রথমত, সরকার ধান ও চালের যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে, ধান-চাল ব্যবসায়ী ও চালকলমালিকেরা সেই দামে খাদ্য অধিদপ্তরের কাছে তা বিক্রি করতে রাজি হননি। তাঁরা বলেছেন, সরকারের নির্ধারিত দাম কম, সেই দামে তাঁরা ধান-চাল বিক্রি করতে পারবেন না। কারণ, তাতে তাঁদের লোকসান হবে। সে জন্য তাঁরা সরকারের কাছে ধান ও চালের দাম বাড়ানোর দাবি জানিয়েছিলেন। কিন্তু সরকার তা করেনি। খোলাবাজার অর্থনীতিতে সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে কোনো ব্যবসায়ীকে কোনো পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য করার উপায় নেই। সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ করার আরেকটি উপায় হলো কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি কেনা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সরকার নিজেই এমন কিছু নিয়মকানুন করে রেখেছে যে চাষিরা সরাসরি খাদ্য অধিদপ্তরের কাছে ধান বিক্রি করতে পারেন না; চাতাল ও মিলমালিকদের কাছে কম দামে বিক্রি করে ক্ষতিগ্রস্ত হন।

এ বছর বন্যার কারণে বোরো মৌসুমে ধানের ফলন অনেক কম হয়েছে। আমন মৌসুমের ধান উঠলে সেই ক্ষতি অন্তত কিছুটা পূরণ হবে—এই প্রত্যাশাও পূরণ হয়নি। আমন ধানের উৎপাদন প্রায় ১৫ লাখ টন কম হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশের মোট চাহিদার তুলনায় চালের সামগ্রিক মজুত এত কম নয় যে সে জন্য দাম ৪৮ শতাংশ পর্যন্ত বেশি হতে পারে। এই বাড়তির আংশিক কারণ সরকারি গুদামে চালের মজুত গত বছরের একই সময়ের তুলনায় অর্ধেক কম। এখন করণীয় হলো, সরকারি মজুত বাড়ানো দেশি ও বিদেশি উভয় উৎস থেকেই। সে জন্য চালের আমদানি শুল্ক কমানো যেতে পারে।