জনতা ব্যাংকের অর্থ চুরি

সম্পাদকীয়

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জনতা ব্যাংকের ‘জনতা এক্সচেঞ্জ কোম্পানি আইএনসি’ (জেইসিআই, ইউএসএ নামে পরিচিত) থেকে ৬ লাখ ৩ হাজার ৯৪৭ মার্কিন ডলার চুরি হওয়ার ঘটনাটি খুবই উদ্বেগজনক। প্রতি ডলার ৮৫ টাকা দরে হিসাব করলে বাংলাদেশি মুদ্রায় তা দাঁড়ায় ৫ কোটি ১৩ লাখ টাকা। সুস্মিতা তাবাসসুম নামের এক কর্মচারী এই অর্থ মেরে দিয়েছেন বলে সন্দেহ করা যাচ্ছে। তিনি পলাতক। ২০১৫ সালে জনতা এক্সচেঞ্জ কোম্পানি আইএনসি যাত্রা শুরুর পর থেকেই সুস্মিতা তাবাসসুম জেইসিআইয়ে টেলিফোন অপারেটর কাম টেলার হিসেবে চাকরি করে আসছিলেন।

গত বুধবার প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, জনতা ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়, জেইসিআই, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংক ১০ মাস ধরে চিঠি চালাচালি করলেও অর্থ উদ্ধার কিংবা সন্দেহভাজন ব্যক্তির সন্ধান করতে পারেনি। তবে জেইসিআই অর্থ উদ্ধারে নিউইয়র্কে মামলা ও আইনজীবী নিয়োগ করেছে। জেইসিআইয়ের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নজরুল ইসলাম ২০১৯ সালের ২৭ জুলাই অবসরে যান। এরপর সেখানে মাহবুবুর রহমান নামে আরেকজনকে পদায়ন করা হয়। কিন্তু তাঁর ভিসাসংক্রান্ত জটিলতার কারণে জেইসিআইয়ের টেলিফোন অপারেটর কাম টেলার সুস্মিতা তাবাসসুমকে কাজ চালিয়ে যেতে বলা হয়। ২০১৯ সালের ২৭ জুলাই থেকে চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি জেইসিআইয়ের দায়িত্ব পালন করেন এবং এই সময়ে অর্থ চুরির ঘটনা ঘটে।

চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি মাহবুবুর রহমান জেইসিআই, ইউএসএর দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রতিষ্ঠানের তহবিলে গরমিল দেখতে পান। সুস্মিতা হাব ব্যাংকে ৫ লাখ ৯ হাজার ৮২০ ডলার জমা দেওয়ার তিনটি রসিদ দেখালেও ব্যাংকে কোনো অর্থ জমা হয়নি। মাহবুবুর বিষয়টি ঢাকায় জনতা ব্যাংকের সদর দপ্তরে জানান। ১ মার্চ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব তদন্তের জন্য দুই দফা চিঠি লেখেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে। এখন পর্যন্ত তারা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

ডলার চুরিই জেইসিআই, ইউএসএর একমাত্র ‘সাফল্য’ নয়। ২০১৫ সালে চালু হওয়ার পর থেকে মোটা অঙ্কের লোকসান দিয়ে আসছে তারা। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২০ জুন পর্যন্ত আয় ছিল ১০ হাজার ৫৪০ ডলার; ব্যয় ছিল ১ লাখ ২ হাজার ৪৪০ ডলার।

স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে বিদেশে জনতা ব্যাংকের এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে চলে? এর কি কোনো নীতিমালা নেই? বিদেশে প্রবাসী শ্রমিকদের বৈদেশিক মুদ্রা পাঠানো তথা ব্যবসা-বাণিজ্যের সহায়তায় এসব প্রতিষ্ঠান খোলা হয়েছিল। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলো মুনাফা করতে পারলে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান কেন লোকসান গুনবে? জনগণের করের অর্থেই এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়। মনে রাখতে হবে, বিদেশে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধার কিংবা অসাধু ও অযোগ্য ব্যক্তিদের পদায়নের জন্য খোলা হয়নি। প্রথমত, সুস্মিতা তাবাসসুম নিয়মিত কর্মচারী নন। দ্বিতীয়ত, তিনি ঢাকা জজকোর্ট বারের সদস্য। একজন অপেশাদার ব্যক্তিকে জনতা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এ রকম ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছে। ফলে ডলার চুরির দায় তারা এড়াতে পারে না।

দেশের ব্যাংকিং খাতে বিশৃঙ্খলা ও দুর্নীতি চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরেই। এ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হলেও পরিস্থিতি যে বদলায়নি, জনতা ব্যাংকের ডলার চুরিই তার প্রমাণ। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি হয়েছিল সুইফট কোড ব্যবহার করে। আর এবার জনতা ব্যাংকের ডলার লোপাট করে দিলেন একজন কর্মচারী। জনতা ব্যাংকের তৎকালীন পর্ষদ সুস্মিতাকে নিয়োগ দিয়েছে। এখন তাঁকে খুঁজে বের করে অর্থ উদ্ধারও তাদের করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত জনতা ব্যাংকের কাছ থেকে জবাবদিহি চাওয়া এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।