টেলিফোনে আড়িপাতা

কয়েকজন মন্ত্রী ও সরকারি দলের নেতার মুঠোফোনে আড়িপাতা নিয়ে যে স্পর্শকাতর প্রশ্নটি সামনে এসেছে, তা হলো সরকারের অগোচরে কীভাবে এ কাজটি প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) নিয়ন্ত্রণে চলছিল। টেলিযোগাযোগ আইনের ৯৭(ক) ধারা অনুযায়ী, রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে কারও টেলিফোনে কথোপকথন গোপনে শোনা, ধারণ বা রোধের দায়িত্ব সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং সরকার সময় সময় নির্ধারিত সময়কালের জন্য বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা বা আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থাকে দিতে পারবে।বর্তমানে আড়িপাতার জন্য প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সদর দপ্তরে জাতীয় তদারকি কেন্দ্র (এনএমসি) রয়েছে। ডিজিএফআই বলছে, কেন্দ্রটি তাদের ভবনে স্থাপিত হলেও এটা তাদের নয়। কেন্দ্রটি আনুষ্ঠানিকভাবে স্থাপিত না হওয়া পর্যন্ত সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে এর কার্যক্রম প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর পরিচালনা করছে। অথচ প্রথম আলোয় গত মঙ্গলবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আড়িপাতার বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানত না। তাহলে কীভাবে সেটা ডিজিএফআইয়ের অধীনে পরিচালিত হচ্ছিল? এ বিষয়ে তদন্ত হওয়া উচিত। কারণ বিষয়টি ‘রাজনীতিতে সেনা হস্তক্ষেপ’ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, যা সেনাবাহিনী ও গণতান্ত্রিক রাজনীতি—উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর।আমাদের দেশে রাজনীতিতে সেনা-সম্পৃক্ততা বারবার ঘটতে দেখা গেছে। বিভিন্ন সরকারের সময় ডিজিএফআইকে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। কোনো দেশেই এ ধরনের সেনা-সম্পৃক্ততা গণতন্ত্রের জন্য শুভ হয় না। পাকিস্তান তার অন্যতম দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশে গণতন্ত্র শক্তিশালী করার জন্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে, দৈনন্দিন রাজনৈতিক ঘটনায় কথায় কথায় সেনাবাহিনী টেনে আনার অনুশীলন বন্ধ করতে হবে। সেদিক থেকে টেলিফোনে আড়িপাতা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণায়ের অধীনে আনা যথার্থই হয়েছে।এখানে দুটি বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে। প্রথমত, চিহ্নিত অপরাধী, খুনি, ছিনতাইকারীসহ সমাজবিরোধীদের বিরুদ্ধে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার জন্য এ ব্যবস্থার ব্যবহার নিশ্চিত করা। ইতিমধ্যে দেশের ছয়টি মোবাইল ফোন কোম্পানির সহযোগিতা পাওয়া গেছে। মুঠোফোনে কথোপকথন রেকর্ড করা ও প্রয়োজনে তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের জানতে দেওয়ার সুব্যবস্থা রয়েছে। এর ফলে অনেক অপরাধীকে গ্রেপ্তার ও তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়েছে। সামাজিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য টেলিফোনে আড়িপাতার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। তবে একই সঙ্গে এর যেকোনো অপপ্রয়োগ রোধ করা দরকার। কারণ আড়িপাতা আসলে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার লঙ্ঘন। সুতরাং অন্যায়ভাবে কোনো ব্যক্তিগত বিষয়ে গোপনে অনুপ্রবেশ বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আড়িপাতা গ্রহণযোগ্য নয়। সরকারের নিয়ন্ত্রণেও এ ধরনের বেআইনি আড়ি পাতা হতে পারে। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি জৈল সিং রাষ্ট্রপতি ভবনের টেলিফোনে আড়িপাতার জন্য রাজীব গান্ধী সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিলেন। ১৯৯০ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথাবার্তা যখন চলছিল, সেই সময় চন্দ্রশেখরের টেলিফোনে আড়িপাতার অভিযোগ উঠেছিল। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি নামে পরিচিত টেলিফোনে আড়িপাতার ঘটনায় ১৯৭৪ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে বিদায় নিতে হয়েছিল। সুতরাং আড়িপাতার বিষয়টি যেন ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক সীমা অতিক্রম না করে, সেদিকটি দেখা দরকার।কখন কার টেলিফোনে আড়ি পাতা হবে, সে সিদ্ধান্ত দেওয়ার সুনির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ থাকতে হবে এবং পুরো বিষয়টি নিয়ন্ত্রিত হতে হবে অনুমোদিত নীতিমালার অধীনে। এ ব্যাপারে জবাবদিহি নিশ্চিত করাও জরুরি।