শিল্প মন্ত্রণালয় অবশেষে সাভারের চামড়াশিল্প নগরে দুটি কোম্পানিকে নিজস্ব বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) নির্মাণের অনুমতি দিয়েছে। এটি একটি সুখবর। তবে এই সুখবরের পেছনের কারণটি হতাশাব্যঞ্জক। ওই চামড়াশিল্প নগরের সব কারখানার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য একটি কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) নির্মাণের কাজ দীর্ঘ আট বছরেও শেষ হয়নি; সেখানে সুষ্ঠুভাবে বর্জ্য পরিশোধন ও নিষ্কাশনের ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি বলে ধলেশ্বরী নদী ও তার আশপাশের পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে।
পাশের জনপদগুলোর অধিবাসীরা দূষণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছেন; চামড়াশিল্পের বর্জ্য থেকে সৃষ্ট পরিবেশদূষণ সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমে অনেক সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো প্রতিকারের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। অবশেষে অ্যাপেক্স ট্যানারি ও বে ট্যানারি নামের দুটি প্রতিষ্ঠান নিজেদের কারখানার বর্জ্য পরিশোধন ও ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যে নিজস্ব উদ্যোগে ইটিপি নির্মাণের অনুমতি চেয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন করে। তার দুই-আড়াই বছর পর এ মাসেই শিল্প মন্ত্রণালয় তাদের অনুমতি দিয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে।
বাংলাদেশের চামড়াশিল্পের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ইতিহাস অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। ঢাকা মহানগরের ভেতরে জনবহুল হাজারীবাগ এলাকায় ট্যানারিপল্লির কারণে বহু বছর ধরে বুড়িগঙ্গা নদী মারাত্মকভাবে দূষিত হয়। অবশেষে চামড়াশিল্পটি হাজারীবাগ থেকে সাভারের হেমায়েতপুরে স্থানান্তরের প্রকল্প নেওয়া হয় ২০০৩ সালে। কিন্তু স্থানান্তর করতে এক যুগের বেশি সময় লেগে যায়। ২০১৭ সালে কারখানাগুলো সেখানে স্থানান্তরের পর দেখা যায়, হাজারীবাগের চামড়াশিল্পের কারণে পাশের বুড়িগঙ্গা যে দূষণের শিকার হচ্ছিল, সে রকম দূষণ শুরু হয় হেমায়েতপুরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ধলেশ্বরী নদীতে। কারণ, নতুন চামড়াশিল্প নগরের বর্জ্য পরিশোধন ও নিষ্কাশনের বিষয়টি ভীষণভাবে অবহেলিত থেকে যায়।
সেখানে ১৫৫টি চামড়া কারখানার বর্জ্য পরিশোধন ও নিষ্কাশনের জন্য একটি কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) ও সার্বিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ৬৪২ কোটি ৭৯ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়। জেএলইপিসিএ-ডিসিএল জেভি নামের একটি চীনা কোম্পানিকে ২০১২ সালের মার্চ মাসে সিইটিপি নির্মাণের কার্যাদেশ দেওয়া হয় এবং তা দেড় বছরের মধ্যেই শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আট বছরেও সেটির নির্মাণকাজ শেষ হয়নি, বর্জ্য ফেলার জায়গাও (ডাম্পিং ইয়ার্ড) এখন পর্যন্ত প্রস্তুত হয়নি। ধলেশ্বরী নদী ও আশপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশের দূষণ চলেছে।
প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষার বিবেচনায় তো বটেই, বাণিজ্যিক বিবেচনায়ও চামড়াশিল্পের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব অনেক। সঠিকভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা না হলে কোনো চামড়াশিল্প আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায় না, ফলে বিশ্বের বড় ব্র্যান্ডগুলো তাদের উৎপাদিত চামড়াপণ্য কেনে না। রপ্তানিমুখী চামড়াশিল্প কোম্পানিগুলোর জন্য ‘লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ’ (এলডব্লিউজি) নামের আন্তর্জাতিক সংস্থার সনদ পাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
রপ্তানিমুখী কোম্পানি অ্যাপেক্স ট্যানারি নিজের খরচে ইটিপি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছে, তারা এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে সিইটিপি নির্মাণ সম্পন্ন হয়নি বলে। কোম্পানিটি প্রায় আড়াই শ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে সংকটে রয়েছে, এখন খরচ বেশি হলেও নিজেদের ইটিপি নির্মাণ করা ছাড়া তাদের উপায় নেই।
আর বে ট্যানারি নামের কোম্পানিটি সাভারের চামড়াশিল্প নগরে বিনিয়োগ করেছিল তাইওয়ানের নামকরা কোম্পানি টেচ্যাং লেদারের সঙ্গে যৌথভাবে। কোম্পানিটি দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে সিইটিপি কার্যকর না হওয়ায় বাংলাদেশ থেকে বিনিয়োগ তুলে নিয়ে চলে গেছে। বে ট্যানারি নিজের বিনিয়োগ রক্ষা করতে অগত্যা নিজেই বাড়তি খরচ করে ইটিপি নির্মাণের উদ্যোগ নিতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু ১৫৫টি কারখানার মধ্যে মাত্র দুটি কারখানা নিজস্ব ইটিপি নির্মাণ করলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সমস্যার সমাধান হবে না। সে জন্য অবশ্যই দ্রুত সিইটিপি নির্মাণের কাজ শেষ করতে হবে।