ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন

সম্পাদকীয়

কারাগারে বন্দী অবস্থায় লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যু ও কার্টুনিস্ট আহমেদ কবিরের ওপর নির্যাতনের কারণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রবলভাবে সমালোচিত হলেও মামলার নামে হয়রানি কমেনি। বরং যাঁর ফেসবুক আইডি কিংবা স্মার্টফোনই নেই, তিনিও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের শিকার হচ্ছেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বলা আছে, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে কেউ যদি অপরাধ সংঘটিত করেন, তাঁকে এ আইনে বিচার করা যাবে। কিন্তু যাঁর এ মাধ্যম ব্যবহারেরই সুযোগ নেই কিংবা যিনি জানেনও না ডিজিটাল জিনিসটি কী, তাঁর বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেওয়ার উদ্দেশ্য কী?

প্রথম আলোর ভৈরব ও কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধির পাঠানো খবর অনুযায়ী, কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট না থাকা এক কৃষকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। ওই কৃষকের নাম আবু জামান। মামলার কারণে তিনি পলাতক। মামলায় বলা হয়, বাদী মিজান শিকদারের বাবা বিলপাড় গজারিয়ার ‘শিকদার মডেল একাডেমি’র অধ্যক্ষ গিয়াস উদ্দিন ওরফে গেনু শিকদারের বিরুদ্ধে ১ নম্বর আসামি আল আমিন তাঁর ফেসবুকে কুরুচিপূর্ণ স্ট্যাটাস দিয়ে পরিবারের সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন করেছেন। ২ নম্বর আসামি আবু জামান এ কাজে তাঁকে প্ররোচনা দিয়েছেন।

কটিয়াদী মডেল থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) শফিকুল ইসলামের দাবি, জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে কৃষক আবু জামানকে এ মামলায় জড়ানো হয়েছে বলে তিনি জানতে পেরেছেন। তদন্তে আবু জামান নিরপরাধ প্রমাণিত হলে তাঁকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে। তদন্ত কর্মকর্তার এ যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। যাঁর ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহারেরই সুযোগ নেই, তাঁর বিরুদ্ধে এ আইনে মামলা হতে পারে না। আবু জামানের তো ফেসবুক বা স্মার্টফোনই নেই। এখানে তো তাঁর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা গ্রহণ করারই সুযোগ নেই। আইনবহির্ভূতভাবে থানা-পুলিশ কারও বিরুদ্ধে মামলা নিতে পারে না। বরং এ ধরনের মামলা কেউ করতে এলে তাদের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া। আবু জামানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়েছে যথাক্রমে ২৫, ২৯ ও ৩১ ধারায়। তাঁর স্ত্রীর অভিযোগ, তাঁদের পরিবারকে অপদস্থ করার জন্য উদ্দেশ্যমূলক এ মামলা দেওয়া হয়েছে।

এ ছাড়া গত দুদিন ঠাকুরগাঁওয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দশম শ্রেণিপড়ুয়া এক স্কুলছাত্রকে এবং দ্বাদশ শ্রেণিপড়ুয়া ১৭ বছর বয়সী এক কলেজছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে ডেইলি স্টার–এর খবরে বলা হয়। দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী একটি ভিডিও প্রচার করেছে, যেখানে একটি দেশের সরকারপ্রধানের বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করা হয়েছে। পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই সে তার মোবাইল থেকে ভিডিওটা মুছে ফেলেছে বলে পুলিশ স্বীকার করেছে। আর এ ক্ষেত্রে পুলিশের মামলা করার এখতিয়ার নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। আইনবিদেরা মনে করেন, তৃতীয় কারও পক্ষে মামলা করার সুযোগ নেই। যিনি বা যাঁরা নিজেদের সম্মানহানি হয়েছে বলে মনে করেন, মামলা করতে হবে তাঁদেরই। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার ও নিরীহ মানুষকে হয়রানি বন্ধ হোক।

যাদের বয়স ১৮ বছরের কম, তাদের শিশু-কিশোর বা অপ্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। থানা-পুলিশ বলেছে, এসব ভিডিও বা প্রচারণা জনমনে অসন্তোষ সৃষ্টি করতে পারে। তাদের দ্বারা যদি সত্যি সত্যি কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকে, অন্য আইনে বিচার হতে পারে; ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে নয়।