ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খড়্গ

স্বাধীন চিন্তা ও মতপ্রকাশ, এমনকি পেশাদার সাংবাদিকতার মাধ্যমে জনসাধারণের তথ্য জানার সংবিধানপ্রদত্ত অধিকার হরণের হাতিয়ার হিসেবে যে আইনটির জুড়ি নেই, সেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার উদ্বেগজনক মাত্রায় বেড়ে চলেছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা আর্টিকেল ১৯-এর বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালে বাংলাদেশে এ আইনের অধীনে দায়ের করা হয়েছে মোট ১৯৮টি মামলা। আসামি করা হয়েছে ৪৫৭ ব্যক্তিকে। ৪১টি মামলার আসামি করা হয়েছে ৭৫ জন পেশাদার সাংবাদিককে। তার আগের বছর, ২০১৯ সালে এ আইনের অধীনে দায়ের করা মোট মামলার সংখ্যা ছিল ৬৩টি।

বাংলাদেশের এ কালাকানুনের ব্যাপক অপব্যবহারের মাধ্যমে সাংবাদিক, শিক্ষক, সংস্কৃতিকর্মী, কার্টুনশিল্পী ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিন্নমত প্রকাশকারীসহ নাগরিকদের ওপর নিপীড়ন ও হয়রানির সমালোচনা করে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে সম্পর্কে লেখা হচ্ছে ‘ডিজিটাল হাইওয়ে বিকামস ডিজিটাল জেল’। গত বছর যে ৭৫ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে মামলা দায়ের করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৩২ জনকে।

তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার যথেচ্ছ অপব্যবহারের মাধ্যমে সাংবাদিকসহ নাগরিকদের ব্যাপক হয়রানির বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা ও প্রতিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে গৃহীত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাংলাদেশে পেশাদার সাংবাদিকতা ও নাগরিকদের স্বাধীন চিন্তা ও মতপ্রকাশের পথে আরও বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে উঠেছে। এ কালাকানুন প্রণয়নের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে ব্যাপক প্রতিবাদ হয়েছে, সরকারকে এই মর্মে সতর্ক করা হয়েছে যে আগের কালাকানুনটির চেয়েও কঠোর এ কালাকানুনের ব্যাপক অপব্যবহার হবে। তার ফলে জনগণের তথ্য জানার অধিকার ক্ষতিগ্রস্ত হবে, নাগরিক স্বাধীনতা খর্ব হবে। আমাদের সংবিধানে প্রদত্ত বাক্ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করে আইনটির সংশোধনের দাবি জানানো হয়েছে। কিন্তু সরকার কোনো কর্ণপাত করেনি। বরং দেখা যাচ্ছে যাঁরা এ আইনের অপব্যবহার করে ভিন্নমত দমন ও স্বাধীন সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ করতে চাইছেন, তাঁদের সম্মুখসারিতে আছেন ক্ষমতাসীন রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজন। ২০২০ সালে এ আইনের অধীনে যে ১৯৮ মামলা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ১৯ মামলা দায়ের করেছেন ক্ষমতাসীন দলের সাংসদেরা নিজেই কিংবা তাঁদের ঘনিষ্ঠ লোকজন।

সাংবাদিক, লেখক, কার্টুনিস্টসহ যেসব নাগরিক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের শিকার হয়েছেন এবং হচ্ছেন, তাঁদের অধিকাংশই জামিনে মুক্তির অধিকার থেকে অন্যায়ভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন। কাউকে কাউকে রিমান্ডে নিয়ে শারীরিক-মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে, এমন অভিযোগ পাওয়া যায়।

কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্টস, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহারের সমালোচনা করেছে। তার চেয়েও বড় কথা, আমাদের উচ্চ আদালত সরকারকে এই মর্মে কারণ দর্শাতে বলেছেন যে কেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ ও ৩১ ধারা অসাংবিধানিক বলে বিবেচিত হবে না। কিন্তু সরকার এখন পর্যন্ত এর কারণ দর্শায়নি, এবং আইনটির বিশেষত ওই দুটি ধারার অপব্যবহার ক্রমাগত বেড়ে চলেছে।

আমরা আগে অনেকবার বলেছি, আবারও বলি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অনেক ধারা বাংলাদেশের সংবিধানের মৌল চেতনা এবং মতপ্রকাশ, অবাধ তথ্যপ্রবাহ এবং মৌলিক মানবাধিকার-সম্পর্কিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আইন ও বিধানের পরিপন্থী। সেই ধারাগুলো বাতিল করে সংবিধান ও আন্তর্জাতিক আইন-বিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ অবিলম্বে নেওয়া হোক।