ঢাকার বায়ুদূষণ

সম্পাদকীয়

হেমন্তে প্রকৃতি যখন শীতল হয়ে আসে, আকাশ স্বচ্ছ হয়ে ওঠে, রাতে শিশির ঝরে, তখন বাতাসেরও নির্মল হয়ে ওঠার কথা। কিন্তু আমাদের প্রিয় রাজধানী ঢাকা মহানগরে ঘটে ঠিক তার উল্টো। এ সময় থেকেই এ শহরে বায়ুদূষণের মাত্রা বাড়তে শুরু করে। গত মঙ্গলবার প্রথম আলোয় খবর বেরিয়েছে, রাজধানীর বাতাসে দূষিত বস্তুকণার পরিমাণ ইতিমধ্যে এমন মাত্রায় বেড়েছে, যা স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। বিশ্বের বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়াল সতর্ক করে বলেছে, ঢাকার বায়ুদূষণ রোধের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হলে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বায়ুর মান অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় থাকবে। এ সময় বয়স্ক মানুষ ও শিশুদের মাস্ক পরে বাইরে বের হওয়া ও দূষিত বায়ু যাতে ঘরে প্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য জানালা বন্ধ রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আমাদের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণকেন্দ্র থেকে দেশের প্রধান ১১টি শহরের বায়ুর মান প্রতিদিন পর্যবেক্ষণেও দেখা যায়, সোমবার রাজধানীর বায়ুর মান খুবই অস্বাস্থ্যকর ছিল।

পৃথিবীর যেসব শহর বায়ুদূষণে ধুঁকছে, সেগুলোর তালিকার একদম শীর্ষের কাছাকাছি স্থান পায় আমাদের ঢাকা। ভারতের দিল্লি সবার ওপরে, ঢাকা ঠিক তার পরেই। কখনো ঢাকা দিল্লিকেও ছাড়িয়ে যায়। গত বছর ‘দ্য স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার-২০১৯’ শীর্ষক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে দেখা গিয়েছিল, বিশ্বের যে পাঁচটি দেশের শতভাগ মানুষ দূষিত বায়ুর মধ্যে বসবাস করে, বাংলাদেশ সেগুলোর অন্যতম। আর বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাবের ফলে মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ পঞ্চম। ২০১৭ সালে বাংলাদেশে ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষ বায়ুদূষণের কারণে মারা গেছে।

বাতাসে মিশ্রিত সালফার, সিসা, দস্তা ইত্যাদি ধাতুকণা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর; বিশেষত শিশুদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রাকৃতিক পরিবেশদূষণের ক্ষতিকর প্রভাবের ফলে বছরে যত মানুষের মৃত্যু ঘটে, তার দুই–তৃতীয়াংশই বায়ুদূষণের ফলে। বায়ুদূষণের কারণে হৃদ্‌রোগ, শ্বাসকষ্টজনিত জটিল সমস্যা, ফুসফুসে সংক্রমণ ও ক্যানসার হয়। বিশেষত শিশু ও গর্ভবতী নারীদের স্বাস্থ্যের ওপর বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব প্রকট।

ঢাকার বায়ুদূষণের কারণগুলোর অন্যতম মাত্রাতিরিক্ত মোটর যানের চলাচল। ফিটনেসহীন মোটর যানগুলো থেকে কালো ধোঁয়াসহ নানা ধরনের বিষাক্ত পদার্থ বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া শহরের চারপাশে প্রচুর ইটভাটায় নিম্নমানের কয়লা, প্লাস্টিক ইত্যাদি পোড়ানোর ফলে বাতাস বিষাক্ত হয়ে পড়ে। তা ছাড়া ঢাকা শহরের ভেতরে ও চারপাশে অজস্র কলকারখানা থেকে দিনরাত দূষণকারী উপাদান বায়ুমণ্ডলে ছড়ায়। এ শহরের আরও একটা বড় সমস্যা হলো এখানে সারা বছরই রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িসহ নানা ধরনের নির্মাণকাজ চলে। তার ফলে প্রচুর ধুলা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে।

ঢাকা মহানগরে অনেক সংস্থা নানা ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত। বায়ুদূষণের কারণগুলো দূর করার বিষয়ে তাদের কোনো ভাবনা আছে কি না, তা জানা যায় না। যেমন কালো ধোঁয়াসহ ক্ষতিকর বস্তুকণা বাতাসে ছড়ানোর জন্য দায়ী ফিটনেসহীন মোটর যানগুলোর চলাচল বন্ধ করার দায়িত্ব বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থার। ঢাকার চারপাশের ইটভাটাগুলোর পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহার নিশ্চিত করার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের, রাস্তাঘাট খোঁড়াখুঁড়ি ও অন্যান্য নির্মাণকাজের সময় ধুলা ওড়ানো বন্ধ করার ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বাধ্য করার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। এসব দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা হলে বায়ুদূষণের মাত্রা অবশ্যই কমানো সম্ভব।

পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুর মান বিভাগের পরিচালক জিয়াউল হক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা গত বছর থেকে অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করে দেওয়া শুরু করেছেন। এ বছর ইটভাটার পাশাপাশি নির্মাণকাজের ধুলা ও যানবাহনের ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আমরা কথা নয়, কাজ চাই।