ঢাকায় মশার ঘনত্ব অস্বাভাবিক

স্যার রোনাল্ড রস শেষ বয়সে দুঃখ করে লিখেছিলেন, ম্যালেরিয়ার ওপর গবেষণার জন্য তাঁকে সর্বোচ্চ স্বীকৃতি হিসেবে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, তাঁর নামে গবেষণা প্রতিষ্ঠান নির্মিত হয়েছে, সম্মান-সমাদরের কমতি নেই; শুধু মশা তাড়ানোর জন্য তিনি যা যা করতে বলেছেন, তার কিছুই করা হয়নি।

কীটতত্ত্ববিদেরা ঢাকা শহরের মশার ঘনত্ব বৃদ্ধির চিত্রসংবলিত যে প্রতিবেদন তুলে ধরেছেন, তা রোনাল্ড রসের সেই আক্ষেপকে ফের মনে করিয়ে দিচ্ছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ওই গবেষণায় ফেব্রুয়ারিতে মশার ঘনত্ব অন্য সময়ের চেয়ে চার গুণ বেশি পাওয়া গেছে বলে বলা হয়েছে। গবেষণাপত্রটি যাঁরা পড়েননি, তাঁদেরও মশকবাহিনীর সাম্প্রতিক অনাহূত উপস্থিতির আধিক্য ও সন্তর্পণ-দংশনের তীব্রতা বুঝতে বেগ পেতে হচ্ছে না।

মশা মারতে বছরে বছরে ঢাকা উত্তর (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ (ডিএসসিসি) দুই সিটি করপোরেশন ক্রমান্বয়ে যেভাবে বাজেট বাড়িয়ে থাকে, তা দিয়ে কামান দাগানোও সম্ভব। দফায় দফায় মশা মারার ওষুধ পাল্টানো হচ্ছে, ওষুধ আমদানিতে টেন্ডারও হচ্ছে। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞ মত হলো, প্রধানত কিউলেক্স মশা বৃদ্ধির মূল উৎস বদ্ধ জলাধার ও নর্দমা। আর ডেঙ্গু ছড়ানো এডিস মশার উৎস বাসাবাড়িতে নির্মাণাধীন উন্মুক্ত আধার ও পরিষ্কার পানি। এই প্রজননস্থল ও ‘আঁতুড়ঘর’ নিয়ন্ত্রণে নিতে পারলে মশার বংশবৃদ্ধির রাশ টেনে ধরা সম্ভব হতো। এর জন্য অনিবার্যভাবেই দুই সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ দরকার।

ডিএনসিসি ৮ থেকে ১৬ মার্চ পর্যন্ত কিউলেক্স মশা নিধনে ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রাম’ চালানোর ঘোষণা দিয়েছে। তারা সমগ্র ঢাকা উত্তরকে সম্পূর্ণ ‘সুইপিং’ করতে চেয়েছে। কিন্তু একই সময়ে ডিএসসিসি একই অভিযান চালাবে, অর্থাৎ সমন্বিতভাবে এ কাজ চলবে—এমন খবর এখনো পাওয়া যায়নি। এখানেই বিপত্তি। যেহেতু মশারা পরিযায়ী এবং ডিএসসিসিতে ‘বসবাসরত’ মশারা ডিএনসিসিতে ‘শিফট’ করবে না বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধও নয়, সেহেতু ডিএনসিসি সমগ্র ঢাকা উত্তরকে ‘সম্পূর্ণ সুইপিং’ করলেও ফল মিলবে না। কারণ, দক্ষিণের মশারা উড়ে গিয়ে উত্তরে বসতি গাড়বে। এ কারণেই দুই সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের সর্বোচ্চ মাত্রার সমন্বয় দরকার। ডিএসসিসির মেয়র আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে মশা নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে গতকাল আশা প্রকাশ করলেও তাতে রাজধানীবাসী কতটা আশ্বস্ত হতে পারছে, তা তর্কসাপেক্ষ বিষয় হিসেবে রয়ে যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেয়র ও নগর ভবনের কর্মকর্তারা আন্তরিক হলে মশক পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছাত না। ছয় মাস সঠিকভাবে মশার ওষুধ ছিটালে হয়তো নিয়ন্ত্রণে আনা যেত। কিন্তু কাজ না করে তাঁরা বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করেছেন। কখন ঝড়-বৃষ্টি হবে আর মশার লার্ভা প্রবহমান

পানিতে ধুয়ে যাবে, সেই আশায় সময় পার হয়েছে। বৃষ্টি হয়নি। খালে পানিপ্রবাহ কমে গেছে। বদ্ধ পানিতে কিউলেক্স মশা বংশবিস্তার করেছে। খোলা নর্দমা নিয়মিত পরিষ্কার না করায়ও সেখানে মশার বংশবিস্তার হয়েছে। জনস্বাস্থ্যের প্রতি এই পাইকারি অবহেলায় এমন দশা হয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে এখন প্রয়োজনে টাস্কফোর্স গঠন করে নিয়মিত অভিযান চালাতে হবে। লোকদেখানো অভিযান, কমিটি গঠন আর মিডিয়া কাভারেজ নিয়ে ব্যস্ত থাকার যে ঐতিহ্য আছে, তা থেকে বেরিয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করতেই হবে।