দখলদারি রক্ষার জন্য এই তৎপরতা?

সম্পাদকীয়

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ঢাকার চারপাশের দখল হয়ে যাওয়া নদী উদ্ধারে যে ধারাবাহিক অভিযান চালাচ্ছে, তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন থাকলেও একেবারে নিষ্ফল বলা যাবে না। কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে তারা নদীর তীর ঘেঁষে ওয়াকওয়ে বা হাঁটাপথ তৈরি করে প্রশংসিতও হয়েছে।

কিন্তু সব প্রভাবশালী ব্যক্তির দখলদারি যে বিআইডব্লিউটিএ বন্ধ করতে পারেনি, তার জ্বলন্ত প্রমাণ রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী সেতুর ওপারে (বছিলা সেতু নামে পরিচিত) নদীর তীর ঘেঁষে ঢাকা-১৪ আসনের প্রয়াত সাংসদ আসলামুল হকের বিশাল সাম্রাজ্য। আইনানুযায়ী নদী, জলাশয় ও পরিবেশ বাঁচিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প করলে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। আসলামুল হক ‘আরিশা প্রাইভেট ইকোনমিক জোন’ ও ‘মায়িশা গ্রুপের পাওয়ার প্ল্যান্ট’ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তা মানেননি।

তুরাগ ও বুড়িগঙ্গার সংযোগস্থলের পাশে পড়েছে ঢাকা-১৪ আসনের প্রয়াত সাংসদ আসলামুল হকের (গত ৪ এপ্রিল মারা গেছেন তিনি) দখলকৃত পুরো এলাকা। কেরানীগঞ্জের ওয়াশপুর ও ঘাটারচর মৌজা এবং সাভারের শ্যামলাপুর মৌজার এই স্থাপনাকে অবৈধ চিহ্নিত করে গত বছরের মার্চ মাসে বিআইডব্লিউটিএ উচ্ছেদ অভিযান চালাতে গেলে বাধা দেন সাংসদ আসলাম। পরে তিনি আদালতের শরণাপন্ন হন। একই সঙ্গে তাঁর প্রকল্পে থাকা জমি বুড়িগঙ্গা বা তুরাগের সীমানার মধ্যে পড়েছে কি না, তা নির্ধারণ করতে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের কাছে আবেদন করেন। অবৈধ দখল উচ্ছেদে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য ২০১৯ সালের ২৩ নভেম্বর বিআইডব্লিউটিএকে চিঠি দেয় কমিশন। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আসলামুল হকের দখল করা জায়গার মধ্যে বুড়িগঙ্গা ও তুরাগতীর এবং বন্দরের সীমার জমি প্রায় ৮ একর, নদীর জমি প্রায় ১৩ একর। বাকি জমি ড্যাপের আওতাভুক্ত।

এখন বিআইডব্লিউটিএ দখল করা নদী উদ্ধার না করে এককভাবে কেন সীমানাখুঁটি বসাচ্ছে, সেটাই বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন। তাঁদের মতে, সীমানাখুঁটি যেখানে বসানো হয়েছে, তার বাইরেও নদীর জায়গা আছে। তাহলে দখলদারকে সুবিধা করে দেওয়ার জন্যই এই তৎপরতা? এ বিষয়ে সংস্থাটির চেয়ারম্যান ‘নদী কমিশনের কাজ নদী কমিশন করেছে, তাঁরা তাঁদের কাজ করছেন’ বলে যে তির্যক মন্তব্য করেছেন, তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। নৌপথ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব বিআইডব্লিউটিএর হলেও নদীর মালিক তারা নয়। আইনানুযায়ী নদীর মালিক জনগণ এবং নদী কমিশন এর অভিভাবক।

নদী কমিশনকে অগ্রাহ্য করে বিআইডব্লিউটিএর সীমানাখুঁটি বসানোর পেছনে কী রহস্য আছে, তা-ও খুঁজে বের করা দরকার। এর আগে তুরাগ নদের সীমানাখুঁটি বসাতে গিয়েও বিআইডব্লিউটিএ একই কাজ করেছিল। নদীর জায়গা বাইরে রেখে সীমানাখুঁটি বসিয়েছিল।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, জীবিত সাংসদের চেয়ে মৃত সাংসদ অনেক বেশি শক্তিশালী। একশ্রেণির কর্মকর্তার অসততা ও দায়িত্বহীনতার কারণে বিআইডব্লিউটিএর ভালো উদ্যোগও সফল হয় না। দখলদারেরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। নদী কমিশনের সুপারিশ মেনেই বিআইডব্লিউটিএকে কাজ করতে হবে। অন্যথায় তাঁরা যত খুঁটি বসাক এবং উচ্ছেদ অভিযান চালাক না কেন, দখল হয়ে যাওয়া নদী উদ্ধার কথায় এবং কাজে বেজায় ফাঁক ও দূরের বাদ্যই থেকে যাবে।