দুদকের মামলা

সম্পাদকীয়

দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দায়িত্ব অর্পিত রয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) হাতে। এই প্রতিষ্ঠান নিজের দায়িত্ব স্বাধীনভাবে ও পক্ষপাতহীনভাবে পালন করবে এবং তার ফলে দেশে দুর্নীতির প্রবণতা ক্রমে হ্রাস পাবে, এমনটাই সাধারণভাবে প্রত্যাশা করা হয়। কিন্তু সেই প্রত্যাশার সামান্য অংশই পূরণ হয়। বরং কখনো কখনো দেখা যায়, দুদক দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে সক্রিয় হয় না। তার কর্মকাণ্ডে একধরনের বাছাই করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং অনুরূপ ব্যক্তিদের প্রশ্রয়প্রাপ্ত ব্যক্তিদের অনেকেই দুদকের সক্রিয়তার সীমার বাইরে থেকে যান। এর প্রধান কারণ দুদকের স্বাধীনতায় সরকারের অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ, যা প্রায়ই সাধারণ দৃষ্টির অন্তরালে রয়ে যায়। তবে কখনো কখনো তা বেশ দৃষ্টিকটু রূপে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।

আমরা তেমনটিই লক্ষ করলাম সম্প্রতি হাইকোর্টের একটি রায়ের বক্তব্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর। ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার ১৪ জানুয়ারি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে দুদকের কর্মকাণ্ডে সরকারের হস্তক্ষেপকে হাইকোর্ট ‘নগ্ন হস্তক্ষেপের শামিল’ বলে বর্ণনা করেছেন। ঘটনা হলো, ২০০৭ সালে সিলেটের সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বরদল উত্তর-৪ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল কাশেমের বিরুদ্ধে ত্রাণের টিন তছরুপের অভিযোগে তাহিরপুর থানায় একটি দুর্নীতির মামলা হয়েছিল। ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এমন আরও অনেক মামলার সঙ্গে এই মামলাও প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়। সিলেটের আদালত ২০১২ সালে সেই মামলা খারিজ করেন। ২০১৪ সালে দুদক সিলেটের আদালতের সেই আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করে। বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ গত বছরের ১০ ডিসেম্বর দুদকের সেই আপিল মামলার রায় দিয়েছেন এবং রায়টির পূর্ণাঙ্গ ভাষ্য পাওয়া গেছে গত বৃহস্পতিবার। সেখানে বলা হয়েছে, দুর্নীতির মামলাটি প্রত্যাহারের যে প্রয়াস সরকারের তরফ থেকে নেওয়া হয়েছিল, তা দুদকের মতো একটি স্বাধীন কমিশনের কর্মকাণ্ডের ওপর ‘নগ্ন হস্তক্ষেপ’ হিসেবে গণ্য করা যায়। কারণ, ২০০৪ সালের দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের ৩(২) ধারায় পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়েছে যে দুর্নীতি দমন কমিশন হবে একটি স্বাধীন ও পক্ষপাতমুক্ত প্রতিষ্ঠান।

আসলে, দুদক যদি কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা দায়ের করে এবং তা পরিচালনার কাজ এগিয়ে নিতে থাকে, তাহলে সেই মামলা প্রত্যাহার করার কিংবা প্রত্যাহারের সুপারিশ করার কোনো এখতিয়ার সরকারের নেই। অবশ্য সরকার দুদকের কাছে সে রকম অনুরোধ জানাতে পারে, কিন্তু দুদক সরকারের সেই অনুরোধ রক্ষা করবে কি করবে না, তা সম্পূর্ণরূপে দুদকের এখতিয়ারভুক্ত বিষয়। সরকারের এখানে কিছু করার এখতিয়ার নেই। কিন্তু তাহিরপুরের এই দুর্নীতির মামলায় সরকার সেই এখতিয়ারবহির্ভূত চেষ্টাটিই করেছে।

দুদকের কর্মকাণ্ডের ওপর সরকারের এমন হস্তক্ষেপের বিষয়ে হাইকোর্টের এই মন্তব্য অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ। আমরা আশা করব, সরকার এটি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করবে এবং দুদকের কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকবে। দেশে লাগামহীন দুর্নীতির ন্যূনতম রাশ টানতে হলে দুদককে স্বাধীনভাবে ও পক্ষপাতহীনভাবে কাজ করতে হবে। সরকারের উচিত সেই কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে বরং সম্ভাব্য সব উপায়ে সহযোগিতা করা।