ভরা বর্ষা মৌসুমে কচুরিপানার ভাসমান ধাপের ওপর শাকসবজির চাষ দক্ষিণাঞ্চলের বিল এলাকার অতি সাধারণ দৃশ্য। এটি শত বছরের
ঐতিহ্যবাহী চাষপদ্ধতি। বিল, হাওর, বাঁওড় এলাকার ফসলি জমি বছরের প্রায় অর্ধেক সময়ই জলমগ্ন থাকে। গ্রামগুলো দ্বীপের মতো পানিবেষ্টিত হয়ে থাকে। কৃষিজমিতে তখন আর ফসল ফলানো যায় না। বিকল্প হিসেবে অনেকে তখন ধাপের ওপর শাকসবজি লাগান। কিন্তু তাঁরা যেভাবে ধাপ
তৈরি করেন, তা বড়জোর ছয় মাস টেকে। শাকসবজির উৎপাদনও হয় খুব সীমিত আকারে।
এই সনাতন পদ্ধতিকে বিজ্ঞানভিত্তিক এবং টেকসই প্রযুক্তিতে রূপান্তর করেছেন বরিশাল কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। এই প্রযুক্তির ফলে ধাপের স্থায়িত্ব যেমন বেড়েছে, তেমনি ফসলের বৈচিত্র্য ও উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় এই পদ্ধতির চাষ দেশের ১৩টি জেলার ২৫টি উপজেলায় ছড়িয়ে দিতে ‘ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ গবেষণা, সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণ প্রকল্প’ নামের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এটি বাস্তবায়ন করবে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট।
এই পদ্ধতিতে বাঁশ দিয়ে অবকাঠামো তৈরির পর নিচে জাল দিয়ে তার ওপর প্রথমে কচুরিপানা দিতে হয়। পর্যায়ক্রমে শেওলা, কচুরিপানা ও দুলালি লতা স্তরে স্তরে সাজিয়ে দুই ফুট পুরু ধাপ বা ভাসমান খেত তৈরি করা হয়। এরপর একটি ধাপের সঙ্গে আরেকটি ধাপে জাল ও ধইঞ্চা দিয়ে মাচা তৈরি করে দেওয়া হয়। এতে লতাজাতীয় সবজি মাচার ওপরে বেড়ে ওঠে এবং ধাপে অন্য শাকসবজিও আবাদ করা যায়। এ ফলন মাটিতে ও প্রচলিত ধাপপদ্ধতির উৎপাদনের প্রায় দেড় গুণ বেশি।
কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ৩০ লাখ হেক্টর মধ্যম থেকে অতি নিচু জমি রয়েছে। তা দেশের মোট ভূমির শতকরা প্রায় ২১ ভাগ। এসব জমির একটি বড় অংশ পতিত থাকে। প্রকল্পটির আওতায় নতুন উদ্ভাবিত ভাসমান কৃষিপ্রযুক্তি ব্যবহার করে জলমগ্ন বা পতিত জমি ফসল আবাদের আওতায় আসবে। এতে ফসলের সার্বিক উৎপাদন বাড়বে। জলমগ্ন এলাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখবে।
প্রচলিত পদ্ধতির ভাসমান খেতে কেবল গাছের চারা ও অল্প কিছু শাকসবজি উৎপাদন করা যেত। নতুন উদ্ভাবিত ধাপে সারা বছর সব ধরনের শাকসবজি, ফল, লতাজাতীয় সবজিসহ অন্যান্য ফসল চাষ করা যাবে। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে সারা বছর মসলা ও মৌসুমি ফলও ফলানো যাবে।
প্রচলিত ধাপপদ্ধতি কেবল দক্ষিণাঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন এই প্রকল্পের মাধ্যমে তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে। এতে জলমগ্ন জমিতে ফসল আবাদের নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে। এ বড় আশার কথা।