কলকারখানা তখন গিলে খাচ্ছিল শ্রমিকদের গোটা জীবন। অসহনীয় পরিবেশে প্রতিদিন ১৬ ঘণ্টা কাজ করতে হতো তাঁদের। ছিল না কোনো ছুটি। তখন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকেরা উপযুক্ত মজুরি আর দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ক্ষুব্ধ শ্রমিকদের রুখতে গিয়ে একসময় পুলিশ বাহিনী শ্রমিকদের মিছিলে এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। এতে নিহত হন ১১ জন নিরস্ত্র শ্রমিক। দিনটি ছিল ১৮৮৬ সালের ১ মে। সেই দিনের পর থেকে বিশ্বজুড়ে শ্রমিকদের অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে।
তবে পাবনার বেড়া উপজেলার নগরবাড়ী নৌবন্দরের শ্রমিকদের ওপর প্রথম আলোয় যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, তা পড়ে মনে হচ্ছে আমরা সেই ১৩৪ বছর আগের অবস্থায় ফিরে গেছি। শনিবার প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, সপ্তাহের সাত দিনই এই বন্দরের শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানো হয়। দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে তাঁরা কাজ করেন। কিন্তু সপ্তাহে কেউ এক দিন ছুটি কাটালে তাঁকে আর কাজে নেওয়া হয় না। তাঁরা কয়লার গুঁড়া, রাসায়নিক সার, সিমেন্টসহ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিভিন্ন পণ্য মাথায় করে বহন করলেও এসব বহনের সময় নেওয়া হয় না স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ কোনো ব্যবস্থা। ফলে সহজেই কয়লার গুঁড়া ও সিমেন্টের ধুলা শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ঢুকে পড়ে তাঁদের ফুসফুসে। আবার সার বহনের সময় ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান পুরো শরীরে লেগে যায়। এতে করে যক্ষ্মা ও ক্যানসারের ঝুঁকিতে আছেন তাঁরা। এ ছাড়া জাহাজ থেকে পণ্য নামাতে হয় সরু কাঠের সিঁড়ি দিয়ে। পা পিছলে পড়ে গিয়ে প্রায়ই শ্রমিকেরা আহত হন।
বাংলাদেশ যখন মধ্যম আয়ের দেশে প্রবেশ করতে যাচ্ছে, সে সময় নগরবাড়ী নৌবন্দরের শ্রমিকদের এ ধরনের দুরবস্থার খবর মেনে নেওয়া যায় না। নগরবাড়ী নৌবন্দরটি এখন উত্তরাঞ্চলের প্রধান পণ্য সরবরাহের মাধ্যম। এ নৌবন্দরের মাধ্যমে উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলায় সার, কয়লা, সিমেন্ট, পাথর সরবরাহ হয়ে থাকে। এসব পণ্য নিয়ে চট্টগ্রাম, মোংলা, নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২টি জাহাজ এ নৌবন্দরে এসে ভেড়ে। এসব পণ্য খালাসের পর তা ট্রাকে তুলে দেওয়ার কাজ করে থাকেন প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক।
যে শ্রমিকেরা দিনরাত পরিশ্রম করে নৌবন্দরটিকে সচল রাখছেন, তাঁরাই যদি স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে থাকেন এবং বঞ্চনার শিকার হন, তাহলে এর চেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার আর কী হতে পারে? বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী, কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার দায়িত্ব নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের। কিন্তু এখানে তা মানা হচ্ছে কই? আমরা নগরবাড়ী নৌবন্দরের শ্রমিকদের এ সংকট নিরসনে শ্রম মন্ত্রণালয়ের সরাসরি হস্তক্ষেপ কামনা করছি। এখানকার শ্রমিকেরা শোভন কাজের পরিবেশ, সাপ্তাহিক ছুটি পাওয়াসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাবেন, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।