নগরীর ঝুলন্ত তার

ঢাকা মহানগরজুড়ে ইন্টারনেট ও কেব্‌ল টিভি নেটওয়ার্কের গ্রাহকদের সংযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা একটি পুরোনো সমস্যা। ঢাকা মহানগরের পাড়া-মহল্লা, বাণিজ্যিক এলাকাসহ সর্বত্র ঝুলন্ত তারের জট-জঙ্গলের যেসব দৃশ্য দেখা যায়, তা সভ্য দুনিয়ার কোনো দেশের রাজধানীর চিত্র হতে পারে না। কিন্তু আমাদের রাজধানীতে এ সমস্যা সমাধানের কার্যকর ও বাস্তবসম্মত উদ্যোগ কখনোই নেওয়া হয়নি। অবশ্য বিদ্যুৎ বিভাগ এসব ঝুলন্ত তার সরানোর বিষয়ে কথা বলে আসছে বহু বছর ধরে। অন্তত ২০১০ সাল থেকে তাদের এ চেষ্টার কথা শোনা যায়, কিন্তু তা এখনো ফলপ্রসূ হয়নি।

সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ঝুলন্ত তার অপসারণের অভিযান শুরু করলে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএসপিএবি) ও কেব্‌ল অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (কোয়াব) এর প্রতিবাদে ধর্মঘটের ঘোষণা দেয়। সরকারের পক্ষ থেকে ‘আর কোনো তার কাটা হবে না’ বলে আশ্বাস দিয়ে ধর্মঘট প্রত্যাহার করার আহ্বান জানালে ওই দুটি সংগঠন তাদের প্রতিবাদ কর্মসূচি স্থগিত করেছে।

কিন্তু এর ফলে সমস্যাটির কোনো সমাধান হলো না, বরং তা বরাবরের মতো ঝুলেই রইল। এ নিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী, এলজিআরডি মন্ত্রী, আইসিটি প্রতিমন্ত্রী, ডিসিসির মেয়র, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা প্রমুখের মধ্যে কথা-চালাচালির খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সর্বশেষ গতকাল ডিএসসিসির মেয়র ফজলে নূর তাপস ঝুলন্ত তার কাটার অভিযান বন্ধ থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। বলা হয়েছে, ইন্টারনেট ও কেব্‌ল টিভি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আগামী নভেম্বর মাসের মধ্যে এসব সংযোগের তার মাটির নিচে নিয়ে যেতে হবে। এ জন্য সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ ডিসিসি দাবি করবে না।

এই বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে সব ঝুলন্ত তার মাটির নিচে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা বাস্তবায়িত হবে কি না, সে বিষয়ে গভীর সংশয় আছে। ইন্টারনেট ও কেব্‌ল টিভি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ নিজ উদ্যোগে এটা কীভাবে করবে, তা স্পষ্ট নয়। ইন্টারনেট সংযোগের জন্য ছয়টি প্রতিষ্ঠানকে ভূগর্ভস্থ ফাইবার অপটিক লাইন বসানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে এই কাজ অংশত সম্পন্ন করেছে। এর মধ্যে আবার ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের উদ্যোগে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কথা বলার ফলে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে, তাতে চলমান সমস্যার জটিলতা আরও বাড়বে। তা ছাড়া এখানে আইনগত জটিলতাও দেখা দিতে পারে।

ইতিমধ্যে যে ভূগর্ভস্থ অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে, ঘরে ঘরে সংযোগের তার পৌঁছানোর ক্ষেত্রে তা ব্যবহার করার উদ্যোগ নেওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে সমন্বিত ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। সিটি করপোরেশনের দৃষ্টি ঝুলন্ত তারের কারণে নগরীর সৌন্দর্যহানির দিকে, এর অবসানের জন্যই তারা সংযোগ কেটে দেওয়ার অভিযান শুরু করেছিল। যদিও নগরের সৌন্দর্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং ঝুলন্ত তারের জট দুর্ঘটনার ঝুঁকির কারণ হতে পারে বলে সেগুলো সরিয়ে মাটির নিচে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন, তবে মাথায় রাখতে হবে যে নগরবাসীর ইন্টারনেট ও কেব্‌ল টিভি সেবা নিরবচ্ছিন্নতা নিশ্চিত করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশেষত চলমান কোভিড-১৯ মহামারির সময়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনাসহ অফিস-আদালতের অনেক কাজ যখন অনলাইনে সম্পন্ন করা হচ্ছে, তখন ইন্টারনেট যোগাযোগ বিঘ্নিত হতে পারে, এমন কিছু ঘটা উচিত নয়।

সে বিবেচনায় আইএসপিএবি ও কোয়াবের ধর্মঘট স্থগিতের ঘোষণা যথার্থ। কিন্তু নভেম্বরের শেষে যেন আবারও একই ঝামেলা দেখা না দেয়, সেদিকে লক্ষ রাখা প্রয়োজন। বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়া সংযোগের ঝুলন্ত তার কাটার অভিযান ও তার প্রতিবাদে ধর্মঘটের পুনরাবৃত্তি কাম্য নয়। তাই সমস্যাটির স্থায়ী সমাধানের উদ্যোগ জরুরি।