নারী নির্যাতন ও বিচারহীনতা

দেশের দুর্বল ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার মধ্যে সব থেকে নাজুক ও ভঙ্গুর অবস্থায় যে নারী ও শিশুরা রয়েছে, তা প্রথম আলোর একটি বিশেষ অনুসন্ধানে ছবির মতো ফুটে উঠেছে। নারীর বিচার না পাওয়ার মূল কারণগুলোর মধ্যে যে দিকটি সব থেকে উদ্বেগজনক তা হলো, নারীর প্রতি বৈষম্য ও অবজ্ঞামূলক পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা। দেশের নানা ক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটলেও এই মানসিকতা বাংলাদেশের সমাজে এখনো ভয়ানক মাত্রায় রয়ে গেছে। নারী নির্যাতন ট্রাইব্যুনালে মিথ্যা বা হয়রানিমূলক মামলা দায়েরের যে সংকটের কথা বলা হয়, সে বিষয়ে গভীর অনুসন্ধান ও এর কারণ বিশ্লেষণ করা দরকার। তবে এ বিষয়টিও চূড়ান্ত বিচারে নারীকে খাটো করে দেখার সামাজিক ব্যাধি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।

গত ৮ মার্চ থেকে ২৩ মে পর্যন্ত ছয় পর্বের এই অনুসন্ধানী ধারাবাহিক প্রতিবেদনে আমাদের দেশে নারীর নিরাপত্তাহীনতা ও অসহায়ত্বের ব্যাপকতা ও গভীরতার বিষয়ে নির্দিষ্টভাবে দালিলিক প্রমাণ হাজির করা হয়েছে। নারী ও শিশুদের সুরক্ষায় ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করা এবং অনেকগুলো অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকলেও বিচার–প্রক্রিয়া যেভাবে চলে তা প্রহসন ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ, ১৮০ দিনে বিচার করা সম্ভব হয় না এবং বিচারহীনতার কারণে মৃত্যুদণ্ড দূরে থাক, অধিকাংশ ক্ষেত্রে লঘু দণ্ডও বিরল। দেশে সব অপরাধের মামলায় দণ্ডলাভের গড় হার ১৫ শতাংশের বেশি। অথচ ঢাকাতেই নারী নির্যাতনের গুরুতর ছয়টি অপরাধের মামলায় সাজার হার ৩ শতাংশের কম। এ থেকে ধারণা করা যায়, রাজধানীর বাইরে এবং কম গুরুতর অপরাধের মামলায় সাজার হার হয়তো আরও কম।

অনুসন্ধানী দলটি ঢাকার পাঁচটি নারী নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ১৫ বছরে আসা ৭ হাজার ৮৬৪টি মামলা ঘেঁটে দেখেছে, মামলাগুলোর প্রতি সার্বিক হেলাফেলা এক মর্মান্তিক সত্য। এ থেকে উতরাতে আইনের ও অন্যান্য সংস্কার লাগবে। কিন্তু বিদ্যমান ব্যবস্থার আওতায় সহজেই কিছু পরিবর্তন এনে একটা উল্লেখযোগ্য প্রতিকার লাভ সম্ভব। নারী ও শিশু নির্যাতন-বিষয়ক মামলার অগ্রগতি জানতে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিশেষ সেল করে করণীয় চিহ্নিত করতে পারে।

অভিযোগপত্র দাখিলের পরই পুলিশের দায়িত্ব শেষ হয় না, সাক্ষী হাজিরার দায় তাদেরই। আসামিরা বেকসুর খালাস পেয়েছে, এমন ৫৫ ভাগ মামলার একটি বড় অংশই নিষ্পন্ন হয়েছে সাক্ষী ও প্রমাণ উপস্থাপনের অভাবে। তাই সাক্ষী সেল করে সাক্ষীদের আইডি, মোবাইল ফোন, ই-মেইলসহ যোগাযোগের ঠিকানা যথাযথ গোপনীয়তা রক্ষা করে সংরক্ষণ করতে হবে। শুনানির নির্দিষ্ট তারিখে তাদের হাজিরা ও তাদের যাতায়াতের বাস্তবসম্মত ভাতা নিশ্চিত করতে হবে।

নির্দিষ্ট সময়ে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া এবং সাক্ষী হাজির করার ক্ষেত্রে পুলিশের ব্যর্থতা চিহ্নিত করে এর জবাবদিহি ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা কার্যকরভাবে তদারক ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন হাইকোর্ট। সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদ তাঁকে এই ক্ষমতা দিয়েছে। আইনে যদিও সুপ্রিম কোর্টের কথা
বলা আছে।

সরকারি কৌঁসুলিরা (পিপি) এখন রাজনৈতিক বিবেচনায় দৈনিক মাত্র ৫০০ টাকা বেতনে নিয়োগ পান। তাঁদের দক্ষতা-যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় উপযুক্ত বেতনে যোগ্য ও দক্ষ আইনজীবীদের পিপি নিয়োগ দিয়ে সরকারি কৌঁসুলিদের নিয়মিত ও স্থায়ী ব্যবস্থা (অ্যাটর্নি সার্ভিস) গড়তে হবে। আমরা পিপি নিয়োগে সরকারের অন্ধ দলীয় নীতি রদকরণ এবং ট্রাইব্যুনালের প্রতি হাইকোর্টের অধিকতর সংবেদনশীল ও সক্রিয় ভূমিকা আশা করি।

সর্বোপরি, থানা থেকে হাসপাতাল ও আদালত পর্যন্ত সর্বত্র নির্যাতনের অভিযোগ আনা নারী ও শিশুর জন্য অনুকূল ও সম্মানজনক পরিবেশ গড়তে হবে। তারা যেন হেনস্তা না হয়, সুবিচার পায়, এ বিষয়ে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কার্যকর মনোযোগ একান্ত দরকার।