নিষ্ক্রিয় সংসদীয় কমিটি

জাতীয় সংসদের কার্যবিধি অনুযায়ী, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোর প্রধান কাজ হলো সরকার বা নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহি নিশ্চিত করা। তারা বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠান সরকারের গৃহীত পরিকল্পনা ও কর্মসূচি ঠিকমতো বাস্তবায়ন করছে কি না, তা পর্যবেক্ষণ, তদন্ত ও সুপারিশ করে থাকে। আমাদের সংসদীয় ব্যবস্থার বয়স প্রায় তিন দশক পার হলেও অনেকটা রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থার আদলেই চলছে। দীর্ঘদিন সামরিক শাসন ও রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা বহাল থাকার পর ১৯৯১ সালে সংসদীয় পদ্ধতি চালু হয় সরকারি ও বিরোধী দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে।

বিএনপির আমলে মন্ত্রীদের সংসদীয় কমিটিগুলোর প্রধান করা হয়েছিল, যা ছিল সংসদীয় রীতির পরিপন্থী। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সেই রীতি বদলে একজন সাধারণ সদস্যকে সংসদীয় কমিটির সভাপতি পদে নিয়ে আসা হয়। যুক্তরাজ্য, ভারতসহ অন্যান্য সংসদীয় ব্যবস্থার দেশে সরকারি হিসাবরক্ষণ কমিটিসহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোর সংসদীয় কমিটি প্রধানের পদ বিরোধী দলকে দেওয়া হয়। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেই রীতি মেনে নিতে পারেননি। ফলে, অনেক সময়ই সংসদীয় কমিটির কার্যক্রম মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একাকার হয়ে যায়।

বর্তমানে সংসদে ৫০টি কমিটির মধ্যে ৩৫টি মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত। কিন্তু গত এক বছরে বেশির ভাগ কমিটি ছিল নিষ্ক্রিয় ও নীরব। সংসদীয় কমিটির প্রধান সরকারের কাছ থেকে যানবাহন, অফিস, কর্মচারীসহ নানা রকম সুবিধা পেলেও তারা বৈঠক করার প্রয়োজন বোধ করেনি। প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনাকালে সংসদের অধিবেশন নিয়মিত বসলেও সংসদীয় কমিটিগুলো ঔদাসীন্য দেখিয়ে আসছে। নিয়ম অনুযায়ী কমিটিগুলোর মাসে অন্তত একবার বৈঠকে বসার কথা। মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত ৩৫টি কমিটির কোনোটি সেই শর্ত পূরণ করেনি। দুটি করে বৈঠক করেছে সাতটি মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত কমিটি। সর্বোচ্চ আটটি বৈঠক করেছে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত কমিটি। অন্যদিকে, এক বছরে একটিও বৈঠক করেনি দুটি মন্ত্রণালয়–সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটি—পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং বস্ত্র ও পাঠ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত কমিটি। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত কমিটির প্রধান বলেছেন, দলের সম্মেলন উপলক্ষে তাঁর কিছু দায়িত্ব থাকায় বৈঠক ডাকতে পারেননি। দলের কাজের জন্য সংসদীয় কমিটির বৈঠক করতে না পারার অজুহাত কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। এর মাধ্যমে একটি সংসদীয় কমিটির প্রধান সংসদের চেয়ে দলের কাজকেই অধিক গুরুত্ব দিলেন। দলের কারণে যিনি সংসদীয় কমিটির বৈঠক ডাকতে পারেন না, তাঁর উচিত স্বেচ্ছায় দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া।

করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে যেখানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির অধিক সক্রিয় থাকার কথা, সেখানে তারাও নির্বিকার ছিল। কমিটি সর্বশেষ মার্চ মাসে বৈঠক করেছে। ইতিমধ্যে ৯ মাস পার হয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগের অনিয়ম-দুর্নীতির পাশাপাশি করোনার সময়ে মাস্ক ও পরীক্ষা নিয়ে যে কেলেঙ্কারি হয়েছে, তা নিয়ে সর্বমহলে সমালোচনা হয়েছে, এখনো হচ্ছে। অথচ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় কমিটি বসার প্রয়োজন বোধ করেনি। এটি কেবল অনাকাঙ্ক্ষিত নয়, অমার্জনীয় বলে মনে করি।

যে সংসদীয় কমিটি সরকারের জবাবদিহি আদায় করার কথা, এখন সেই সংসদীয় কমিটিরই জবাবদিহি করার সময় এসেছে।