পার্বত্য চুক্তির দুই যুগ

পার্বত্য চুক্তির ২৪ বছর পরও চুক্তির মূল বিষয় অমীমাংসিত থাকা ও সেখানে অব্যাহত সংঘাত-সংঘর্ষ কেবল পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জন্যই উদ্বেগের বিষয় নয়, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্যও অশনিসংকেত।

পাহাড়ে দীর্ঘ দুই দশক ধরে চলা সংঘাতময় পরিস্থিতির অবসান ও সেখানকার জনগণের ভাগ্যোন্নয়নে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তি সই হয়েছিল। চুক্তিতে সই করেছিলেন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে তৎকালীন চিফ হুইপ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)।

চুক্তিতে বলা হয়েছিল, ‘উপজাতি পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে উপজাতি অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে বিবেচনা করিয়া এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ এবং এই অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়ন অর্জন করার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করিয়াছেন।’ সরকারের অভিযোগ, পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের বিভিন্ন সংগঠনের বিরোধের কারণেই সেখানে সংঘাতময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে। অন্যদিকে জনসংহতি সমিতি বলছে, যে সংগঠন চুক্তি সই করেছে, তাদের নেতৃত্বে পাহাড়িরা ঐক্যবদ্ধ আছে। সরকার সেই ঐক্য ভাঙার জন্য বিভিন্ন নামে সংগঠনকে লেলিয়ে দেওয়ার কারণেই সেখানে শান্তি আসছে না।

চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠিত হলেও এসব সংস্থার কাছে স্থানীয় শাসনসহ যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ন্যস্ত করার কথা ছিল, অদ্যাবধি তা করা হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা করে নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কে সেখানে স্থায়ী বাসিন্দা আর কে অস্থায়ী বাসিন্দা, সেই বিষয়টি এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান সমস্যা ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করার লক্ষ্যে চুক্তি অনুযায়ী ভূমি কমিশন গঠন করা হয়েছে। কিন্তু এখনো তারা কাজ শুরু করতে পারেনি বিধিমালা জারি না হওয়ার কারণে। যদিও ভূমি কমিশন আইন নিয়ে জনসংহতি সমিতির যে আপত্তি ছিল, তা আমলে নিয়ে সরকার ২০১৬ সালে তা সংশোধন করেছে। অন্যদিকে ভূমি কমিশন কাজ শুরু করার আগেই নাগরিক পরিষদের নামে পাহাড়ে বসবাসরত পুনর্বাসিত বাঙালিরা সেখানে চুক্তিবিরোধী তৎপরতা চালাচ্ছে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময়ে যেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামে ৯৮ শতাংশ পাহাড়ি জনগোষ্ঠী ছিল; সেখানে আজ তারা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। সে ক্ষেত্রে ‘উপজাতি অঞ্চলের’ বৈশিষ্ট্য বজায় রাখা কীভাবে সম্ভব হবে? চুক্তিতে স্থানীয় সরকার সংস্থায় পাহাড়িদের প্রাধান্য দেওয়া হলেও নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান যেমন পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদে বাঙালিদের পাল্লা ভারী।

অত্যন্ত দুঃখজনক হলো, ২৪ বছর আগে যে আওয়ামী লীগ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সই করেছিল, এখনো তারা ক্ষমতায় আছে। চুক্তি সইয়ের পর প্রথম দফায় তারা যথেষ্ট সময় না পেলেও ২০০৯ সাল থেকে টানা ১৩ বছর ক্ষমতায় আছে। সে ক্ষেত্রে চুক্তির কোনো ধারা বা ধারাসমূহ বাস্তবায়িত না হলে তার দায় ক্ষমতাসীনেরা এড়াতে পারে না।

চুক্তি সইয়ের দুই যুগ পরও যদি সেখানে শান্তি না এসে থাকে, সরকারকেই এর কারণ খতিয়ে দেখতে হবে। একে অপরের ওপর দোষারোপ করে সমস্যার সমাধান হবে না। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলে কিংবা সেখানে অর্থনৈতিক উন্নতি হলে তার সুফল পুরো দেশের মানুষই পাবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফিরিয়ে আনতে হলে চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।