পুঁজিবাজার

সম্পাদকীয়

নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিতে পরিবর্তন আসার পর কিছু সংস্কার বা উদ্যোগের ফলে পুঁজিবাজারে একধরনের স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে। সূচকের সঙ্গে বেড়েছে লেনদেনও। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, তলানিতে আটকে থাকা এই বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বেড়েছে।

দীর্ঘ প্রায় এক দশক পর এই বাজারে এখন কিছুটা স্বস্তি লক্ষ করা যাচ্ছে, যার অন্যতম কারণ হিসেবে বলা যায়, নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে পরিবর্তন। এই পরিবর্তনে যদি অগ্রগতি হয়, তাহলে প্রশ্ন ওঠে—যাঁর ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা ছিল না, তাঁকে ৯ বছর এসইসির চেয়ারম্যান পদে রাখা হয়েছিল কেন? এ কথা খুবই স্পষ্ট যে সাবেক চেয়ারম্যান খায়রুল হকের সময়ে বিনিয়োগকারীদের অনাস্থা, বাতাসে তাঁকে ঘিরে নানা গুজব-গুঞ্জন এবং তাঁর অদক্ষতায় এই খাত তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। তাঁকে রাখার কারণে যদি লাখ লাখ বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হন, তাহলে ব্যক্তি হিসেবে তিনি এবং সরকার এর দায় এড়াতে পারে না।

করোনা-পরবর্তী সময়ে অর্থনীতির ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে, শেয়ারবাজারও অনতিক্রম্য বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসেছে। গত জুলাই মাসের শুরুতে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বাজার মূলধন ছিল ৩ লাখ ১১ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা, এখন তা প্রায় ৩ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা। ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসই প্রশস্ত সূচক পাঁচ হাজারের কাছাকাছি, লেনদেন এখন ৮০০ থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা।

দায়িত্ব নেওয়ার পর পুঁজিবাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার অঙ্গীকার করেছেন বিএসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম, কিছু পদক্ষেপও নিয়েছেন। উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের শেয়ার ধারণ করা নিয়ে কড়াকড়ি আরোপের সুফল মিলেছে। বাজারে নতুন নতুন কোম্পানি নিয়ে আসার চেষ্টা আছে, যদিও আইপিওর মূল্য নির্ধারণের প্রক্রিয়াটি এখন পর্যন্ত প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়।

করোনার কারণে বিনিয়োগ না থাকায় ইতিমধ্যে পুঁজিবাজারে অলস টাকা ঢুকেছে, কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়েছে, ব্যাংকের ঋণ ও আমানতের সুদের হার কমেছে। নানাভাবে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ এসেছে। সরকারের নানা পদক্ষেপের ফলে তারল্যসংকট অনেকটাই কেটে গেছে।

তবে এই পরিস্থিতির মধ্যেও কিন্তু বাজার কারসাজির সঙ্গে জড়িতরা থেমে নেই। বিনিয়োগকারীরা সাদাচোখে কারসাজি দেখতে পাচ্ছেন। শেয়ারবাজারে বিমা খাতের কিছু কোম্পানির শেয়ারের দাম দ্বিগুণ, তিন গুণ, চার গুণ পর্যন্ত বেড়েছে, যা পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে মোটেও স্বাভাবিক নয়। দুর্বল কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক বাড়লেও নিয়ন্ত্রক সংস্থার নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বাজারে কোনো পক্ষই যাতে ‘ব্যাড প্লে’ করতে না পারে, সেদিকে সংস্থাটির তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে।

বাংলাদেশে পুঁজিবাজারের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, সরকারি প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাগুলোর হস্তক্ষেপ ও ইনডেক্স নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা, যা মোটেই কাম্য নয়। কারণ, বাজার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলে টেনে ধরা বা পড়ে গেলে ওঠানোর চেষ্টা দীর্ঘমেয়াদি সুফল আনতে পারে না। তাই বাজারকে এখন নিজস্ব শক্তিতে চলতে দিতে হবে।

বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার মূল দায়িত্বও কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থার। যদি কেউ না বুঝে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে সর্বস্বান্ত হন, তাহলে সে দায় ওই ব্যক্তিকেই নিতে হবে। কিন্তু এই বাজারে গিয়ে কেউ প্রতারণার শিকার হলে সেই দায় কমিশনের, এ জন্য বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করতে হবে।

এসইসির ক্ষমতার সঙ্গে আর দশটি সংস্থার পার্থক্য হচ্ছে, এই কমিশন নিজের আইন নিজেই প্রণয়ন করতে পারে। এর আধা বিচারিক ক্ষমতা রয়েছে। সরকারের অনেক কমিশন আছে, যেগুলো নামসর্বস্ব ও নখদন্তহীন। কিন্তু এসইসির ক্ষমতা অনেক, অংশীজনেরা এর ক্ষমতার সুষ্ঠু প্রয়োগ দেখতে চায়। নিরপেক্ষভাবে আইন ও ক্ষমতার প্রয়োগ করলে এবং এই বাজারকে নিজের গতিতে চলার সুযোগ করে দিলে উন্নয়নের যাত্রায় শেয়ারবাজার বড় ভূমিকা রাখবে।