পুনর্জাগরণে চাই সম্মিলিত প্রচেষ্টা

সম্পাদকীয়

সংস্কৃতি রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিফলন; আবার রাষ্ট্র ও সমাজের মানবিক ও গণতান্ত্রিক রূপান্তরের সেতুবন্ধও। বাংলাদেশের সমাজের প্রধান প্রধান ঐতিহাসিক বাঁকবদলে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কেন্দ্রীয় ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সংস্কৃতি সেই ভূমিকা থেকে পিছু হটেছে।

সমাজে একদিকে যেমন সাম্প্রদায়িক রাজনীতিভিত্তিক সংস্কৃতির প্রভাব বেড়েছে, অন্যদিকে প্রগতিশীল সংস্কৃতিচর্চা তার প্রভাব হারিয়েছে। সার্বিকভাবে দেশের সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি গভীর সংকটে পড়েছে।

সম্প্রতি প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক নেতারা ‘সংস্কৃতিক্ষেত্রে আমরা কি পরাজিত হচ্ছি?’এমন প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁরা মনে করেন, ধর্মীয় মৌলবাদের ক্রমাগত উত্থান, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষ শক্তির নানামুখী প্রচারণা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আমলাতান্ত্রিক প্রতিবন্ধকতা, সাহসী ও প্রতিবাদী মানসিকতার অভাব—এগুলোই প্রধানত দেশের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অচলাবস্থার সৃষ্টি করেছে।

সংস্কৃতির বর্তমান সংকট ও অচলাবস্থার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণও উঠে এসেছে গোলটেবিলে। ১. বাজার অর্থনীতির কারণে সংস্কৃতিও এখন পণ্য, আবার প্রযুক্তির কারণে সংস্কৃতিতে দৃশ্যমাধ্যমের উত্থান। ২. শহর ও গ্রামে সংস্কৃতিচর্চায় যোগসূত্রের অভাব। ৩. সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের উদ্‌যাপনমুখিনতা ও অতি রাজধানীকেন্দ্রিকতা। ৪. অতীতে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের উদ্যোক্তা মধ্যবিত্তের ভোগবাদে অভ্যস্ততা। ৫. মৌলবাদের প্রসার প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগের নমনীয়তা এবং ক্ষেত্রবিশেষে নিষ্ক্রিয়তা। ৬. রাষ্ট্র ও সমাজের ত্রুটি নিয়ে সংস্কৃতির প্রশ্ন করতে না পারা এবং ভয়ের সংস্কৃতির বিস্তার।

৭. সংস্কৃতিচর্চার অবকাঠামো ও প্রশিক্ষণের সুবিধা না থাকা এবং এ খাতে রাষ্ট্রের বরাদ্দ বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা না করা। ৮. প্রবল রাজনৈতিক বিভাজন ও ব্যক্তিস্বার্থ। ৯. যাত্রা, পালাগান, বাউলগানে সরকারি নিয়ন্ত্রণ। ১০. ইতিহাসের গণ্ডি আঁকা একমাত্রিক ভাষ্যের বাইরে নতুন কিছু ভাবতে না পারা। ১১. জনগণের আন্দোলনের সঙ্গে সাংস্কৃতিক কর্মীদের আন্দোলনের ব্যবধান। ১৩. রাজনৈতিক মানের সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক মানেরও পতন।

সংকট থেকে উত্তরণে শিক্ষার মাধ্যমে দীর্ঘ মেয়াদে সংস্কৃতি পুনরুদ্ধার, সংস্কৃতির বিকেন্দ্রীকরণ, মৌলবাদের প্রসার প্রতিরোধে অনমনীয়তা, প্রতিটি উপজেলায় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তোলা এবং তাকে সজীব রাখা, জাতীয় পর্যায়ে বড় বড় সাংস্কৃতিক সম্মেলন ও পর্যায়ক্রমে তা জেলা পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়ার মতো পরামর্শ এসেছে। শিক্ষা ও সংস্কৃতিকর্মী এবং বুদ্ধিজীবীদের নিজেদের চিন্তা ও তৎপরতা নিয়ে নিজেদের প্রশ্ন করা এবং সাহসী ও সৃজনশীলভাবে ভাবার কথাও উঠে এসেছে।

ভাষাকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং সেই পথ ধরেই মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। কিন্তু স্বাধীনতার ৫১ বছর পর সংস্কৃতির পিছু হটা নিয়ে বড় প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার যে বাংলাদেশ, সেখানে গণতান্ত্রিক, মানবাধিকারমুখী, বহুত্ববাদী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সংস্কৃতির বিকাশ রুদ্ধ হয়ে পড়লে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। এতে সমাজ ক্রমশ পিছিয়ে পড়বে।

এরই বাস্তব চিত্র রাজনীতিসহ সর্বত্র দেখতে যাচ্ছে। তবে সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবনের যথেষ্ট সুযোগ এখনো রয়েছে। আলোচনায় শিক্ষাবিদ ও লেখক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেছেন, ‘সংস্কৃতিক্ষেত্রে আমরা পিছু হটেছি, অনেকখানি ভূমি হারিয়েছি, কিন্তু পরাজিত হইনি।’

সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ জরুরি। কিন্তু কোনো ত্যাগস্বীকার না করে ক্ষমতার ছায়ায় সংস্কৃতিচর্চার কারণেই যে সংস্কৃতি ক্রমাগত তার সাহস হারিয়েছে এবং জনবিচ্ছিন্ন হয়েছে, তা কি রাজনীতিবিদ ও সংস্কৃতির নেতাদের উপলব্ধিতে আসছে?