পৌরসভা নির্বাচনের প্রথম ধাপ

আগামীকাল ২৮ ডিসেম্বর যে ২৪টি পৌরসভার নির্বাচন হতে যাচ্ছে, নির্বাচন কমিশনের ভাষ্য অনুযায়ী তার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। শনিবার মধ্যরাত থেকে প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণা বন্ধ হয়ে গেছে। রাত পোহালেই ভোট গ্রহণ শুরু হবে। করোনাকালে একসঙ্গে এতগুলো স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন হওয়ায় সংশ্লিষ্ট এলাকায় স্বাস্থ্যঝুঁকির প্রশ্ন আছে। তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হলো, জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত হবে কি না। কে এম নূরুল হুদা কমিশন আগের ব্যর্থতা কাটিয়ে মোটামুটি একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করতে পারবে কি না।

প্রথম আলোসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে যেসব খবর আসছে, তা মোটেই আশ্বস্ত হওয়ার নয়। তফসিল ঘোষণার পর সরকারি দলের মনোনীত প্রার্থীরা অবাধে প্রচারণা চালিয়েছেন, সভা-সমাবেশ করেছেন। কিন্তু বিএনপি বা অন্যান্য বিরোধী দলের প্রার্থীদের সেই সুযোগ থেকে বলতে গেলে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। বিএনপির প্রার্থীদের অভিযোগ, তাঁদের কর্মী-সমর্থকদের মাঠেই নামতে দেওয়া হয়নি। কোথাও কর্মীরা সাহস করে নামলেও সরকারি দল হামলা চালিয়েছে। বাধা এসেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকেও।

একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের পূর্বশর্ত হলো মাঠ সমতল রাখা বা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সমান সুযোগ দেওয়া। পৌরসভা নির্বাচনে এক দলের প্রার্থীর মাঠ দাপিয়ে বেড়ানো এবং অন্য দলের প্রার্থীকে ‘গৃহবন্দী’ করে রাখার জবরদস্তি থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নির্বাচনের কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তারা নিরপেক্ষভাবে অর্পিত দায়িত্ব পালন না করে প্রার্থীবিশেষের পক্ষে অবস্থান নেন। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।

পৌরসভা নির্বাচনের প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে প্রথম আলো যে তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করেছে, তা–ও উদ্বেগজনক। তথ্যটি হলো, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের সম্পদ বেড়েছে আর বিএনপি বা বিরোধী দলের প্রার্থীদের বেড়েছে মামলা। কোনো কোনো প্রার্থীকে অর্ধডজন কিংবা তার চেয়েও বেশি মামলার খড়্গ নিয়ে নির্বাচনী লড়াইয়ে নামতে হয়েছে। অতীতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা ছিল, তা প্রত্যাহৃত হয়ে গেছে। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিটাই হলো ক্ষমতায় থাকলে সম্পদ বাড়ে, আর বিরোধী দলে থাকলে বাড়ে মামলা।

নির্বাচনের তিনটি পর্ব থাকে—ভোট গ্রহণ-পূর্ব, ভোট গ্রহণ ও ভোট গ্রহণ-পরবর্তী। যেকোনো নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য করতে হলে তিন পর্বেই মাঠ সমতল রাখা প্রয়োজন। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভোট গ্রহণ পর্বে ভোট কারচুপি বা জালিয়াতি ঠেকাতে প্রতিটি বুথে প্রত্যেক প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্ট থাকা আবশ্যক। যদিও সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে ভোটকেন্দ্রে কেবল সরকারদলীয় প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্টদের দেখা যায়, অন্য কোনো প্রার্থীর এজেন্টকে সেখানে ঢুকতে দেওয়া হয় না। এ অবস্থায় নির্বাচন প্রহসনে পরিণত হয়। এ নিয়ে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে এন্তার অভিযোগ থাকলেও নির্বাচন কমিশন কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ‘অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে’ ধরনের মুখস্থ কথা বলে থাকেন।

নির্বাচন কমিশন যদি ২৪টি পৌরসভা নির্বাচনে ভোটারদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে না পারে, তাহলে নির্বাচনের নামে আরও একটি প্রহসন মঞ্চস্থ হবে, যা গণতান্ত্রিক ও নির্বাচনী ব্যবস্থাকে অধিকতর বিপর্যস্ত করবে।