পৌরসভায় সিইও

সম্পাদকীয়

দেশের প্রথম শ্রেণির পৌরসভাগুলোতে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়ার যে উদ্যোগ সরকার নিয়েছে, তার উদ্দেশ্য নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বলছে, পৌরসভাগুলোর আর্থিক সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে এ পদক্ষেপ। আর পৌরসভার মেয়ররা মনে করেন, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ওপর খবরদারি করতে পৌরসভাগুলোতে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা দেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশে বর্তমানে ৩২৮টি পৌরসভা আছে। এর মধ্যে ক শ্রেণির পৌরসভার সংখ্যা ১৯৪। উল্লেখ্য, খ ও গ শ্রেণি তো বটেই, ক শ্রেণির অনেক পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ১ মাস থেকে ৬০ মাস পর্যন্ত বকেয়া পড়েছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেসব পৌরসভার কর্মচারীদের বেতন-ভাতা এক বছরের বেশি বকেয়া থাকবে, সেগুলো ভেঙে দেওয়া হবে। তাদের এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত করার সুযোগ কম। যে পৌরসভা নিজের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতে পারছে না, সেই পৌরসভা পৌরবাসীর সেবা করবে কীভাবে?

অস্বীকার করার উপায় নেই যে পৌরসভাগুলোকে আর্থিকভাবে সক্ষম করে গড়ে তুলতে হবে। পৌরসভাগুলোর আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস পৌরবাসীর কাছ থেকে নেওয়া হোল্ডিং ট্যাক্স বা পৌর কর। সরকারের নতুন উদ্যোগের পেছনে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে যে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ভোটের রাজনীতির কারণে পৌর কর বাড়ান না। অনেক পৌরসভায় এক যুগের বেশি সময় ধরে একই পৌর কর ধার্য আছে। আবার সেই করও বছরের পর বছর বকেয়া থাকে।

অনেক পৌরসভা গঠিত হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়, সক্ষমতা যাচাই না করেই। আবার অনেক পৌরসভায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত লোকবল নিয়োগ করায় আর্থিক বোঝা বেড়েছে। ফলে জনসেবার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত এসব প্রতিষ্ঠান নিজের ভারেই ন্যুব্জ।

তাই নতুন কোনো উদ্যোগের আগে সরকারকে পৌরসভাগুলোর সংকটের মূল কারণ খুঁজে বের করতে হবে। নীতিনির্ধারকদের মনে রাখতে হবে, গ্রামাঞ্চলে ইউনিয়ন পরিষদ ও শহরাঞ্চলে পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন স্থানীয় সরকারব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বায়ত্তশাসন ও স্বাতন্ত্র্য অবস্থান খর্ব করা যাবে না। পৌরসভাগুলোর আর্থিক দুরবস্থার দায়ও এককভাবে মেয়র-কাউন্সিলরদের ওপর চাপানো ঠিক হবে না। এর জন্য সরকারের কেন্দ্রীভূত নীতিও অনেকাংশে দায়ী।

সংবিধানে শক্তিশালী স্থানীয় শাসনের কথা বলা আছে। কিন্তু বাস্তবে স্থানীয় শাসন বা সরকার বলতে যে প্রতিষ্ঠানকে বোঝায়, তার অস্তিত্ব নেই বললেই চলে।

পৌরসভাগুলোর আয়ের উৎস বাড়াতে হবে। প্রতিবেশী ভারতসহ যেসব দেশে শক্তিশালী স্থানীয় সরকার আছে, সেসব দেশে স্থানীয় উন্নয়ন পরিকল্পনাও তারা করে থাকে। আমাদের দেশে নানা স্তরে স্থানীয় সরকার থাকলেও উন্নয়ন পরিকল্পনার ৯০ শতাংশ প্রণীত হয় কেন্দ্রীয়ভাবে। ফলে স্থানীয় সরকার ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হয়েছে। উপজেলা পরিষদে নির্বাচিত প্রতিনিধি ও স্থানীয় প্রশাসনের দ্বন্দ্ব কারও অজানা নয়। আইনে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান প্রধান হলেও স্থানীয় প্রশাসন তঁাকে পাশ কাটিয়ে অনেক সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।

সিইও নিয়োগের মাধ্যমে পৌরসভাগুলোতেও দ্বৈত শাসন কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে না। রাষ্ট্রযন্ত্রের কোনো পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ওপর আমলাতন্ত্রের খবরদারি কাম্য নয়। পৌরসভাগুলো আর্থিকভাবে সচ্ছল হোক তা আমরাও চাই। কিন্তু এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে। ওপর থেকে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলে তার হিতে বিপরীত হতে পারে।