প্রণোদনা প্যাকেজ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি/ রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।’ করোনা সংকট মোকাবিলায় সরকারঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের অবস্থা অনুরূপ না হলেও তেলা মাথায় তেল দেওয়া বলে যে প্রবাদটি চালু আছে, এখানে তারই প্রতিফলন লক্ষ করা যাচ্ছে। সম্প্রতি প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবরের শিরোনাম ছিল ‘অর্থনীতি পুনরুদ্ধার কর্মসূচি: বড়রা পাচ্ছে, ছোটরা ঘুরছে’।

করোনার প্রাদুর্ভাবে দেশের ছোট-বড় সব উদ্যোক্তা কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তিন মাসের লকডাউনে শিল্পকারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য হয়ে পড়েছিল স্থবির। অনেক মানুষ কাজ হারিয়ে শহর ছেড়ে গ্রামে যেতে বাধ্য হয়েছেন। অর্থনীতিবিদদের মতে, পুঁজি বেশি বলে বড় উদ্যোক্তারা সহজে প্রাকৃতিক কিংবা মানবসৃষ্ট ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেন। পুঁজি কম বিধায় ছোট উদ্যোক্তাদের প্রাথমিক ধকল কাটিয়ে ওঠাই কঠিন হয়ে পড়ে। সে ক্ষেত্রে ঋণ বা প্রণোদনা প্রয়োজনটা তাঁদেরই বেশি। অথচ এ ঋণের বেশির ভাগই পেয়েছেন বড় উদ্যোক্তা বা প্রতিষ্ঠান। এ ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত সমস্যা যেমন আছে, তেমনি আছে ব্যাংকের বড়দের প্রতি পক্ষপাতও।

করোনাকালে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকট মোকাবিলায় সরকার ১ লাখ ১১ হাজার ১৩৭ কোটি টাকার ২০টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। এর মধ্যে ৮৫ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা দেওয়ার কথা ঋণ আকারে ব্যাংকিং চ্যানেলে। ব্যাংকভিত্তিক তথ্যে জানা যায়, প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় সোনালী ব্যাংক ১ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা (লক্ষ্যমাত্রার ৭৭.৬৩ ভাগ), জনতা ব্যাংক ৪৫৮ কোটি টাকা (৯৩.৪৭ ভাগ), অগ্রণী ব্যাংক ৬৮২ কোটি টাকা (৬৬.৬৬ ভাগ), রূপালী ব্যাংক ৩০৩ কোটি টাকা (৩৭.১৩ ভাগ) এবং বেসিক ব্যাংক ৩৪ কোটি টাকা (লক্ষ্যমাত্রার ৩২ ভাগ) বিতরণ করেছে।

ক্ষতিগ্রস্ত বড় শিল্প ও সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ৩৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ প্যাকেজের মধ্যে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ২৫ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। শতাংশের হিসাবে বিতরণের হার প্রায় ৭৮ শতাংশ। এ ছাড়া বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসকে সোনালী ব্যাংক এক হাজার কোটি টাকা দিয়েছে এ প্যাকেজ থেকে। বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি ১১৫ কোটি, সিটি সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ ৫০ কোটি এবং আবুল খায়ের স্টিল ৩৫ কোটি টাকা পেয়েছে।

অন্যদিকে কুটির, অতি ক্ষুদ্র ও মাঝারি বা সিএমএসএমই উদ্যোক্তাদের খুব কমই ঋণ পেয়েছেন। অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা জানিয়েছেন, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেওয়ার পরও ব্যাংকগুলো থেকে তাঁরা কোনো সাড়া পাননি। হয়রানি ও টালবাহানার শিকার হচ্ছেন। কৃষিঋণ পেতেও কৃষকেরা একই রকম ভোগান্তিতে আছেন।

ছোট ও মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তাদের ঋণ না পাওয়ার বিষয়টি নীতিনির্ধারকদেরও দৃষ্টি এড়ায়নি। অতি সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক ভার্চ্যুয়াল বৈঠকে এ খাতে ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ বিতরণ শতভাগ বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত
ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। ছোট উদ্যোক্তাদের ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আরেকটি সমস্যা হলো তথ্যের ঘাটতি। ব্যাংকের কাছে বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের তথ্যাবলি থাকলেও ছোটদের তথ্য নেই।

বড় উদ্যোক্তাদের ঋণের প্রয়োজনীয়তা কেউ অস্বীকার করছে না। রপ্তানির বাজার ফিরে পেতে এসব শিল্প নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কিন্তু অধিক শ্রমশক্তিনির্ভর ছোট উদ্যোক্তাদেরও বাঁচাতে হবে। আমরা আশা করব, অর্থ মন্ত্রণালয় কেবল নির্দেশনা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করবে না, সেই নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যাংকগুলো যাতে দ্রুত ঋণ বিতরণ করে, সেটিও তারা নিশ্চিত করবে।