প্রণোদনার অর্থ পরিশোধ

সম্পাদকীয়

করোনাকালে সংকট উত্তরণে সরকার বিভিন্ন খাতে মোটা অঙ্কের প্রণোদনা ঋণ দিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেওয়া হয়েছে রপ্তানিমুখী শিল্প খাতে—৩০ হাজার কোটি টাকার মতো ঋণ দেওয়া হয়েছে। দুই থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে এই ঋণ শোধ করার কথা।

এই অবস্থায় কৃষকেরা সময়মতো ঋণ পরিশোধ করে ভালো নজির স্থাপন করলেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) ৮ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকার ঋণ শোধ করেছেন তাঁরা। এই অর্থ গত বছরের একই সময়ে কৃষকদের শোধ করা ৬ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকার চেয়ে ১ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকা বেশি। চলতি অর্থবছরে দেশের ৫৯টি ব্যাংকের মোট কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ২৬ হাজার ২৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে জুলাই-অক্টোবর সময়ে বিতরিত হয়েছে ৬ হাজার ৬২৯ কোটি টাকা, যা পুরো অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার ২৫ দশমিক ২২ শতাংশ।

কৃষিঋণ পরিশোধের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণ প্রথমত, এ বছর কৃষকেরা শস্যের ভালো দাম পেয়েছেন। দ্বিতীয়ত, ফলনও বেশি হয়েছে। তৃতীয়ত, কৃষিঋণের সুদহার কমে ৪ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে এবং তাঁরা অতীতের ঋণও সাশ্রয়ী সুদে পরিশোধ করার সুযোগ পাচ্ছেন। আগেভাগে কৃষিঋণ শোধ হওয়ার আরেকটি কারণ হলো ঋণের একটা অংশ বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) মাধ্যমে বিতরিত হয়। ব্যাংকগুলো ছাড় দিলেও তারা ঋণ আদায়ে সচেষ্ট থাকে।

এই ঋণ দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক পাঁচ হাজার কোটি টাকার পুনঃ অর্থায়ন তহবিল গঠন করে। বাংলাদেশ ব্যাংক ১ শতাংশ সুদে ব্যাংকগুলোকে ঋণ দেয়। ব্যাংক কৃষকদের দেয় সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ সুদে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত শস্য খাতে ৩ হাজার ৫৪৩ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো। কৃষকদের সেচযন্ত্র কিনতে ৫৬ কোটি টাকা, কৃষি যন্ত্রপাতি কিনতে ৪২ কোটি টাকা, পশুপাখি ও হাঁস-মুরগি পালনে ১ হাজার ৬৫ কোটি টাকা, মৎস্য খাতে ৭২৪ কোটি টাকা, শস্য সংরক্ষণ ও বিপণনে ৪০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে।

এতে প্রমাণিত হলো, পরিবেশ–পরিস্থিতি অনুকূল হলে কৃষকেরা খেলাপি হন না। অনেক সময় কৃষককে ঋণ পেতে নানা বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। এ বিষয়েও নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মতে, এটা কৃষি খাতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে। যেসব কৃষক ঋণ পেয়েছেন, তাঁদের অনেকে উৎপাদন বাড়াতে ভূমিকা রাখবেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, কৃষক ছাড়াও যেসব উদ্যোক্তা কৃষিপণ্য কিনে সরাসরি বিক্রি করেন, তাঁরাও এই স্কিমের আওতায় ঋণ নিতে পারবেন। তবে এ ক্ষেত্রে কোনো উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান এককভাবে পাঁচ কোটি টাকার বেশি ঋণ নিতে পারবে না।

এ কথা মানতেই হবে, করোনাকালে কৃষকেরাই দেশবাসীর খাদ্যের জোগান দিয়েছেন। উপকূলীয় অঞ্চলে আম্পানের থাবা ও দেশের প্রায় অর্ধেক এলাকাজুড়ে দুই দফা বন্য সত্ত্বেও তাঁরা এক দিনও কৃষিপণ্য উৎপাদন বন্ধ রাখেননি। কৃষকই আমাদের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। সরকারের উচিত কৃষকের প্রণোদনা আরও বাড়ানো। কেননা, তাঁরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার করেন না। সময়মতো ঋণ শোধ করেন।

রপ্তানিমুখী শিল্পসহ অন্যান্য খাতের ঋণগ্রহীতারাও কৃষকদের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে পারেন। সবাই সময়মতো ঋণ শোধ করলে পরবর্তী বিনিয়োগের সুযোগ যেমন বাড়বে, তেমনি দেশের অর্থনীতিও হবে গতিশীল।