প্রধান বিচারপতির আক্ষেপ

চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট ভবনের জন্য সব জায়গা এখনো অধিগ্রহণ করা হয়নি, এ তথ্য দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন হতাশার সুরে বলেছেন, ‘আমি আর কত বলব।’ এ প্রসঙ্গে তিনি গাজীপুরের মতো জায়গায় চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের জায়গা অধিগ্রহণ না হওয়ার কথা উল্লেখ করেন।

প্রধান বিচারপতির এ বক্তব্যে বিচার বিভাগের প্রতি নির্বাহী বিভাগের উদাসীনতা ও বিমাতাসুলভ মনোভাবই প্রকাশিত। সরকার সমস্যা দেখেও না দেখার ভান করছে; না হলে প্রধান বিচারপতিকে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের জায়গার জন্য বারবার মন্ত্রীকে তাগাদা দিতে হবে কেন?

ক্ষমতাসীনেরা অনেক সময় নিজেদের ব্যর্থতার দায় পূর্বসূরিদের ওপর চাপিয়ে থাকেন। এ ক্ষেত্রে সেই সুযোগ কম। নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করা হয় ২০০৭ সালে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। এরপর তারা ক্ষমতায় ছিল ২০০৮ সাল পর্যন্ত। ২০০৯ সালের সূচনায় ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ একনাগাড়ে এক যুগের বেশি সময় ধরে দেশ শাসন করছে। বিচার বিভাগের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলে যেমন তারা কৃতিত্ব দাবি করতে পারে, তেমনি প্রতিশ্রুত কাজ শেষ না হওয়ার দায়ও তাদের নিতে হবে।

মামলার জট কমাতে দুই থেকে তিন গুণ বিচারক নিয়োগ করা প্রয়োজন বলে প্রধান বিচারপতি যে মন্তব্য করেছেন, নির্বাহী বিভাগ তা কতটা গুরুত্বের সঙ্গে নেয়, তা দেখার বিষয়। বিচারক বাড়ানোর সঙ্গে বিচার বিভাগের বরাদ্দ বাড়ানোর প্রশ্নটি জড়িত। গত অর্থবছরে আইন ও বিচার বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা ছিল মাত্র ১ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। সুপ্রিম কোর্টের জন্য বরাদ্দ ১৯৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিচার বিভাগের জন্য মোট বরাদ্দ দাঁড়ায় ১ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা। শতাংশের হিসাবে মাত্র শূন্য দশমিক ৩৫২ ভাগ। অর্থাৎ বাজেটের ১০০ টাকার মধ্যে বিচার বিভাগ পাচ্ছে ৩৫ পয়সা। গত পাঁচ অর্থবছরের বাজেট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিচার বিভাগের জন্য বাজেটের দশমিক ৫০ শতাংশও বরাদ্দ করা হয়নি।

অন্যদিকে মামলার জট বেড়েই চলেছে। ২০০৮ থেকে ২০২০ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত নতুন মামলা দায়ের ও পুনর্জীবিত মামলার মোট সংখ্যা ১ কোটি ৫৯ লাখ ৫ হাজার ৬৬১। আর নিষ্পত্তি হয়েছে ১ কোটি ৩৮ লাখ ৬৩ হাজার ২৫০টি মামলা। দেশের অধস্তন আদালতগুলোতে বিচারকের সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ৮০০। বাংলাদেশে প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য একজন বিচারক, যা উন্নত দেশ তো বটেই, প্রতিবেশী ভারতের তুলনায়ও কম।

সম্প্রতি প্রয়াত সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু গত বছর জাতীয় সংসদে বাজেটের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে বিচার বিভাগের বরাদ্দ বাড়ানোর তাগিদ দেওয়ার পাশাপাশি নিম্ন আদালতে বিচারকের সংখ্যা অন্তত তিন হাজার করার দাবি জানিয়েছিলেন। আরেক সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদও বলেছেন, বিচার বিভাগের বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।

রাষ্ট্রের তিন স্তম্ভের কোনো স্তম্ভ দুর্বল থাকলে পুরো কাঠামোটি দুর্বল হতে বাধ্য। এর চেয়েও জরুরি কথা হলো, ন্যায়বিচার বা অন্যায়ের প্রতিকার পাওয়া মানুষের মৌলিক অধিকার। সরকার কোনো অজুহাতেই তা থেকে তাদের বঞ্চিত করতে পারে না। অতএব, চলতি বছরের বাজেটে বিচার বিভাগের জন্য বরাদ্দ বাড়ানো হোক, যাতে অন্তত জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের জায়গা কিংবা নিম্ন আদালতের বিচারকস্বল্পতার জন্য প্রধান বিচারপতিকে আবার আক্ষেপ করতে না হয়।