প্রবাসী শ্রমিকদের সংকট

সম্পাদকীয়

যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাসের নতুন ধরনের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পরিপ্রেক্ষিতে সৌদি আরবের সরকার সে দেশের সঙ্গে বিশ্বের সব দেশের বিমান চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়ার ফলে বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক প্রবাসী শ্রমিক নতুন করে গুরুতর সমস্যায় পড়েছেন। এই মহামারিকালে জাতীয় অর্থনীতি যখন বহুমুখী অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে, তখন এটি একটি বড় দুঃসংবাদ। কারণ, বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বড়সংখ্যক প্রবাসী শ্রমিকের গন্তব্যদেশ সৌদি আরব। তাঁদের মাধ্যমে আমরা সে দেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করি। বিমান চলাচলে এই নতুন আরোপিত নিষেধাজ্ঞা যদি ন্যূনতম দুই সপ্তাহ চলে, তাহলেই যে শ্রমিকেরা সৌদি আরবে যাওয়ার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিলেন, তাঁরা নানা জটিলতা ও আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বেন।

দেশের ভেতরে কর্মসংস্থানের প্রকট ঘাটতির কারণে বিদেশে কাজ করতে যাওয়ার প্রবণতা আমাদের শ্রমিকদের মধ্যে এত বেশি যে তাঁরা নানা রকমের ঝুঁকি নিয়েও বিদেশে যেতে চান। কোভিড-১৯ মহামারির এই বছরেও গত সোমবার পর্যন্ত দুই লাখের বেশি বাংলাদেশি শ্রমিক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গেছেন। এ থেকে অনুমান করা যায়, এ দেশে কত বেশিসংখ্যক মানুষকে আয়-রোজগারের জন্য মরিয়া হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও বিদেশে পাড়ি জমাতে হয়।

এ বছর দুই লাখের বেশি বিদেশগামী বাংলাদেশি শ্রমিকের সবচেয়ে বড় অংশটি গেছে সৌদি আরবে। সেই দেশে ২০ থেকে ২২ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক আছেন; একটি দেশে এটাই আমাদের শ্রমিকদের সর্বোচ্চ সংখ্যা। দেশটিতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত ৯৫৯ জন বাংলাদেশি শ্রমিক মারা গেছেন; কিন্তু তারপরও সে দেশে কাজ করতে যেতে আগ্রহী শ্রমিকের সংখ্যা কমেনি। ভিসা-টিকিট ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুত করে এবং উড়োজাহাজে ওঠার বাধ্যবাধকতার অনুসরণে করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষা করিয়ে যাঁরা সৌদি আরবগামী বিমানে ওঠার অপেক্ষায় ছিলেন, ফ্লাইট স্থগিত হওয়ার ফলে তাঁরা নতুন করে সমস্যায় পড়লেন। কবে আবার ফ্লাইট চালু হবে, তা এখনো নিশ্চিত নয়; তবে এটা নিশ্চিত যে চালু হওয়ার পর তাঁদের আবারও করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষা করিয়ে সনদ নিতে হবে। বেশি দেরি হলে নতুন করে আবারও ভিসা নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।

কোভিড-১৯ মহামারি শুরু হওয়ার পর বিদেশগামী শ্রমিকেরা একবার ক্ষতির শিকার হয়েছিলেন; মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিদেশে শ্রমিক যাওয়া বন্ধ ছিল; উপরন্তু প্রবাসী অনেক শ্রমিককে সৌদি আরবসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ফিরে আসতে হয়েছে কর্মসংস্থান হারিয়ে, অনেকে ছুটি নিয়েও এসেছেন। এসবের অর্থনৈতিক ক্ষতির বিষয়টি এই মানুষদের পরিবারগুলোর জন্য কতটা গুরুতর, তা বলার অপেক্ষা রাখে না; জাতীয় অর্থনীতির ওপর এর নেতিবাচক প্রভাবও কোনোভাবেই উপেক্ষণীয় নয়। সে কারণেই আমরা দেখেছি, সেপ্টেম্বরে বিদেশে শ্রমিক যাওয়া নতুন করে শুরু হওয়ার পর থেকে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক বিদেশে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন; শুধু চলতি মাসের তিন সপ্তাহেই গেছেন ১৭ হাজার ৬৩০ জন।

শীতের আগমনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কোভিড মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়া কিংবা এর পরিপ্রেক্ষিতে সৌদি সরকারের সব দেশের সঙ্গে বিমান যোগাযোগ স্থগিত করার এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে আমাদের কোনো হাত নেই। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে আমাদের রাষ্ট্রের প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য অবশ্যই কিছু করণীয় আছে এবং তা গুরুত্বের সঙ্গে দ্রুতগতিতে করা উচিত। তাঁদের জন্য সরকার যে ৭০০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ গ্রহণ করেছে, তা কার্যকর করার গতি এখন পর্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। এ পর্যন্ত মাত্র ৯ কোটি টাকা স্বল্প সুদে ঋণ হিসেবে প্রবাসী শ্রমিকদের হাতে পৌঁছেছে। এই প্যাকেজ বাস্তবায়নের গতি আরও অনেক বাড়ানো জরুরি প্রয়োজন।