বাঁধ রক্ষায় ভরসা স্বেচ্ছাশ্রম

খুব বেশি দিন হয়নি, এই মে মাসেরই ৪ তারিখ ‘মতামত’ পাতায় ‘কয়রা বাঁধের করুণ দশা’ শিরোনামের এক সম্পাদকীয়তে যে আশঙ্কা আমরা করেছিলাম, তাকেই সত্যে পরিণত করল ইয়াস। জীর্ণশীর্ণ বাঁধ ভেঙে ফসলের খেত, লোকালয়ে ঢুকে পড়ল সর্বনাশা লোনাজল। শেষ প্রায় আট মাস আগে কয়রায় আম্পানের লোনাপানি ঢুকেছিল, সেই অভিশাপ থেকে মাত্র কিছুদিন হয় মুক্ত হয়েছিল তারা, আবার এখন বিভিন্ন জায়গায় পানি ঢুকে গেল। কে জানে এই পানি মুক্ত হতে আবার তাদের কত দিন লাগবে।

এই বিপদে তাদের সহায় যে কেউ নেই, তা তাদের ভালো করেই জানা। তাই তো কারও আশায় বসে থাকেনি তারা, শয়ে শয়ে ছুটে এসেছে, নিজেদের জায়গাজমি, ভিটে, ফসল বাঁচানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা করেছে। দিনরাত স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করেছে তারা। তারা খুব ভালো করেই জানে এটা বেগার শ্রম, বিনিময়ে কোনো টাকা তারা পাবে না। কোথাও তাদের উদ্যম কাজে দিয়েছে, আবার কোথাও ভরা পূর্ণিমার প্রবল জোয়ার ভাসিয়ে নিয়ে গেছে তাদের বালুর বাঁধ।

কিন্তু ইয়াসের আগমনও আকস্মিক নয়। অন্তত সাত দিন আগে থেকেই তার আগমনী ঘোষণা করছিল দুনিয়ার প্রধান কয়েকটি দেশের আবহাওয়া মডেল। তখন থেকেই কি স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড ও প্রশাসন উদ্যোগ নিতে পারত না? জরুরি ভিত্তিতে জনগণকে সম্পৃক্ত করে বাঁধের যে জায়গাগুলো সবচেয়ে নাজুক, পারত না কি তার সেই জায়গাগুলোকে সারাই করতে? এখন প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যে প্রবল স্রোতের বিপরীতে যে কাজটা তারা করছে, অনুকূল আবহাওয়ায় সেই কাজটা কি তারা করতে পারত না? ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে কেন এই তৎপরতা, আগে চালালে ক্ষতি কী?

আবহাওয়াবিশারদেরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝড়–জলোচ্ছ্বাসের মাত্রা ও পরিমাণ সামনের দিনগুলোতে বাড়তেই থাকবে। এ বাস্তবতায় উপকূলকে সুরক্ষিত না করে আমাদের উপায় নেই। উপকূল সুরক্ষার প্রধান পূর্বশর্তই হচ্ছে সুরক্ষিত বাঁধ। সেই ষাটের দশকে দক্ষিণাঞ্চলের এ বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলো তৈরি করা হয়েছিল। তারপর সিডর, আইলা, মহাসেন, বুলবুল, আম্পান—কত ঝড় এল গেল, কিন্তু সমন্বিত কর্মসূচির আওতায় বাঁধগুলোকে ভালো করে সারানোর কোনো উদ্যোগ দেখা গেল না, বদলে যা করা হয় সোজা বাংলায় তাকে বলে জোড়াতালি, আমরা নিশ্চিত ইয়াসের পরেই তাই হবে। কিন্তু এই জোড়াতালি দিয়ে আর কত দিন।

দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলবর্তী মানুষগুলোকে আর কিছু দিতে পারি আর না পারি, নিজ ভিটেমাটিতে নির্বিঘ্নে থাকার পরিবেশটুকু তো অন্তত আমরা নিশ্চিত করতে পারি। খাওয়া-পরার দাবি তো তারা করছে না, উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা গেলে তার ব্যবস্থা তারা নিজেরাই করে নিতে পারবে। তাদের এই চাওয়াটা কি খুব বেশি?