বার্নিকাটের গাড়িতে হামলা

সম্পাদকীয়

সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটের গাড়িবহরে হামলার ঘটনায় পুলিশ যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, তাতে কেবল অপরাধকে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়নি, অপরাধীদের রক্ষায় ‘ষড়যন্ত্রতত্ত্ব’ সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। অভিযোগপত্রে বলা হয়, ‘সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র হচ্ছে’ এমনটা মনে করে আসামিরা মার্শা বার্নিকাটের গাড়িবহরে হামলা করেছিলেন।

২০১৮ সালের ৪ আগস্ট রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটের গাড়িবহরে হামলা হয়। ওই রাতে তিনি মোহাম্মদপুরে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের বাসায় যান। নৈশভোজ শেষে ফেরার পথে তাঁর গাড়িতে হামলা চালায় অস্ত্রধারীরা। আনুমানিক রাত ১১টায় ছাত্রলীগের নাইমুল হাসান ওরফে রাসেলের নেতৃত্বে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের একটি দল ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। তারা মার্শা বার্নিকাটের গাড়ি ধাওয়া করলে রাষ্ট্রদূত দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। এ সময় বদিউল আলম মজুমদারের বাড়িতেও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়।

মার্শা বার্নিকাটের গাড়িবহরে হামলার প্রায় আড়াই বছর পর স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের ৯ জন নেতা-কর্মীকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। গত ১৮ জানুয়ারি ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে ডিবি অভিযোগপত্র জমা দিলেও প্রায় দেড় মাস পর গত শুক্রবার বিষয়টি জানাজানি হয়।

উল্লেখ্য, মার্শা বার্নিকাট ২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে ঢাকায় আসেন এবং চার বছর দায়িত্ব পালন শেষে ২০১৮ সালের ২ নভেম্বর নিজ দেশে ফিরে যান। তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেছেন, তাঁরা আসামিদের ধরার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আসামিরা বলছেন, পুলিশ তাঁদের খোঁজ করেনি। কেবল টেলিফোনে নাম-ঠিকানা জানতে চেয়েছে। ঘটনার পর হামলার নিন্দা জানিয়ে বাংলাদেশ সরকার বিবৃতিও দেওয়ার পাশাপাশি যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিল। মার্শা বার্নিকাটকে বহনকারী গাড়ির ওপর হামলার তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে বাংলাদেশের কাছে জানতে চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। হামলার ঘটনাটিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়ার এবং এ ব্যাপারে কার্যকর ও নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়েছে তারা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সাম্প্রতিক যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময়ও বিষয়টি নিয়ে কথা হয়েছে বলে জানা গেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, যতটুকু জানা গেছে, অপরাধীরা চিহ্নিত হয়েছে। বিচার অবশ্যই হবে।

কিন্তু পুলিশের তদন্তে যদি ষড়যন্ত্রতত্ত্বই প্রাধান্য পায় এবং আসামিদের দেখেও না দেখার ভান করে, তাহলে বিচার হবে কীভাবে? সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র হচ্ছে, এ ধারণার ওপর কোনো নাগরিক বিদেশি রাষ্ট্রদূতের গাড়িবহর কিংবা অপর কোনো নাগরিকের বাড়িতে হামলা চালাতে পারেন না। সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের প্রবেশ, তল্লাশি ও আটক হইতে স্বীয় গৃহ নিরাপত্তা লাভের অধিকার থাকিবে বলে সংবিধানে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে।’

তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের গাড়িবহরের ওপর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাটি একটি ফৌজদারি অপরাধ। বিএনপির শাসনামলে জঙ্গিরা তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর বোমা হামলা চালিয়ে তাঁকে গুরুতর আহত করেছিল। আর মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ওপর হামলার ঘটনা ঘটিয়েছেন আওয়ামী লীগেরই স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা।

যে সরকার দেশের ভাবমূর্তি রক্ষায় সদা উদ্বিগ্ন, সেই সরকারের আমলে একজন বিদেশি রাষ্ট্রদূতের গাড়িবহরে হামলার বিচার না হওয়া কিংবা বিচার নিয়ে টালবাহানা করা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। অবিলম্বে আসামিদের গ্রেপ্তার করে বিচার নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হোক।