বাস্তবের পথে স্বপ্নের পদ্মা সেতু

সম্পাদকীয়

গত বৃহস্পতিবার সব কটি স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে বহুমুখী পদ্মা সেতুর মূল কাঠামোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ শেষ হলো। স্থাপিত হলো নদীর দুই পারের মধ্য সংযোগ। পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এটি মাইলফলক অগ্রগতি। যান চলাচলের জন্য কবে এ সেতু খুলে দেওয়া হবে, দেশবাসী এখন সেই প্রতীক্ষা করছে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার বহুপ্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়সীমা ধরা হয়েছিল ২০১৪ সাল। কিন্তু ‘দুর্নীতির চেষ্টার অভিযোগ’ এনে অর্থায়ন বন্ধ করে দেয় এর প্রধান অর্থায়নকারী সংস্থা বিশ্বব্যাংক। অন্যান্য দাতা সংস্থাও তাদের অনুসরণ করে; যদিও পরে প্রমাণিত হয় দুর্নীতির চেষ্টার অভিযোগটি সঠিক ছিল না।

পদ্মা সেতু প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করার ঘোষণা দেন। সে সময় দেশি-বিদেশি অনেক বিশেষজ্ঞ এ প্রকল্পের পরিণতি নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। এরপর ২০১৮ সালকে সময়সীমা ধরে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। সেতুর নকশা সংশোধন, বন্যা, ভাঙনসহ নানা কারণে নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করা সম্ভব হয়নি। চলতি বছরের মার্চ মাসে করোনার প্রাদুর্ভাব ঘটলে কাজের গতি আরও মন্থর হয়ে যায়। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, গত নভেম্বর পর্যন্ত পদ্মা সেতুর কাজের সার্বিক অগ্রগতি ৮২ দশমিক ৫ শতাংশ। মূল সেতুর কাজ এগিয়েছে ৯১ শতাংশ। আর নদীশাসনের কাজ হয়েছে ৭৬ শতাংশ।

৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন পদ্মা সেতু দেশের বৃহত্তম উন্নয়ন প্রকল্প। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ সেতু দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলাসহ দেশের অন্যান্য এলাকার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হবে। এতে ওই অঞ্চলের আর্থসামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যেরও প্রসার ঘটবে, শিল্পায়ন হবে ও কর্মসংস্থান বাড়বে। পদ্মা সেতু চালু হলে একসময়ের অবহেলিত দক্ষিণাঞ্চল রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আসবে। এ সেতু দিয়ে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে ও মহাসড়কের সঙ্গে যুক্ত হবে। মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর দিয়ে নেপাল, ভুটান এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য পরিবহন সহজ হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পদ্মা সেতু চালু হলে ১ থেকে ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বাড়বে।

চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন লিমিটেড পদ্মা সেতুর মূল কাজ করলেও এর সঙ্গে আরও বহু সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান যুক্ত। বাংলাদেশসহ ১৪টি দেশ যুক্ত হয়েছে এ মহাকর্মযজ্ঞে। কোনো কোনো দেশ থেকে বিশেষজ্ঞ এসেছেন, কোনো কোনো দেশের যন্ত্রপাতি ও মালামাল ব্যবহৃত হচ্ছে। বিদেশি প্রকৌশলী, প্রযুক্তিবিদ, কারিগর ছাড়াও দেশের ৭০ জন প্রকৌশলী ও পাঁচ হাজার শ্রমিক পদ্মা সেতু নির্মাণকাজে যুক্ত হয়েছেন। এটি কেবল উন্নয়ন প্রকল্প নয়, পুরো জাতির আকাঙ্ক্ষা ও সক্ষমতার সম্মিলন।

প্রশ্ন এসেছে এ প্রকল্পের কাজ কবে নাগাদ শেষ হবে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের প্রধান এম শামীম জেড বসুনিয়া বলেছেন, পদ্মা সেতু সচল হতে দেড় বছর সময় লেগে যাবে। সে ক্ষেত্রে ২০২২ সালের জুনের মধ্য শেষ হওয়ার কথা। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করেন, জনবল বেশি নিয়োগ করলে আগেও সেতু চালু করা সম্ভব। সরকারের নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর কিংবা ২০২২ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে উদ্বোধনের পক্ষপাতী।

এসব দিবসের সঙ্গে আমাদের আবেগ–অনুভূতি খুবই জোরালো এবং সেটা করা গেলে খুবই ভালো হবে। তবে এ ক্ষেত্রে বাস্তবতা বিবেচনায় নেওয়াই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কোনোভাবেই তাড়াহুড়া করা ঠিক হবে না। আমাদের গর্বের এ প্রকল্পের কাজে সামান্য ত্রুটি কিংবা দুর্বলতা কাম্য নয়। যৌক্তিক সময়েই এর কাজ শেষ হোক।