বায়ুদূষণ ও কোভিড–১৯

সরকারের অঙ্গীকার, হাইকোর্টের নির্দেশ, গবেষণা প্রতিবেদনের আশঙ্কা এবং মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়া—এত কিছুর পরও বায়ুদূষণ কমছে না। জনবহুল এই ভূখণ্ডে ২০১২ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে বায়ুদূষণজনিত রোগব্যাধিতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশের আদালত, পরিবেশবাদী সংগঠন ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ছাড়াও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের গবেষণায় বিষয়টি সুস্পষ্ট।

ধারাবাহিকভাবে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়লেও এটা প্রতিরোধের প্রয়াস যথেষ্ট বলা যায় না। ‘বিশ্ব বায়ু পরিস্থিতি-২০২০’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য হচ্ছে, গত বছরও বায়ুদূষণজনিত রোগে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৫০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর আগে ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়ায় হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন হাইকোর্ট। গত এপ্রিলে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে তলব করে আদালত বলেন, ‘বায়ুদূষণ রোধে নেওয়া পদক্ষেপ আমাদের হতাশ করেছে। আমরা ক্ষুব্ধ। আমাদের সন্তানদের রক্ষা করতে হলে এসব (বায়ুদূষণ) বন্ধ করতে হবে।’

বিশ্ব বায়ু পরিস্থিতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, যেসব দেশের বায়ুর মান খারাপ, সেসব দেশে করোনা সংক্রমণ দ্রুত হবে। আমাদের দেশে শীতকালে বায়ুর মান বেশ খারাপ হয়ে যায়। অক্টোবরে বায়ুদূষণ শুরু হয়, ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলতে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দূষিত বাতাসের কারণে ফুসফুসের কর্মক্ষমতা কমতে পারে। করোনাকাল আসার পর আমরা সবাই কমবেশি জানতে পেরেছি যে এই ভাইরাসের অন্যতম লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে ফুসফুস।

উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে, এ বছর বায়ুর মান এতটাই খারাপ যে বর্ষা থাকতেই ঢাকার বায়ুর মান বিশ্বের শীর্ষ দূষিত বায়ুর শহরগুলোর তালিকায় ঢুকে পড়েছে। বুধবার সন্ধ্যায় শীর্ষ দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার অবস্থান ছিল তৃতীয়। তবে এ অবস্থা শুধু ঢাকার জন্যই যে প্রযোজ্য তা নয়, চট্টগ্রামসহ দেশের বায়ুর মানের দ্রুত অবনতি লক্ষ করা যাচ্ছে। কিছুটা ব্যতিক্রম রাজশাহী, যেখানে সবুজ বেড়েছে এবং দূষণ কমেছে।

বাংলাদেশের বায়ুদূষণ রোধে নির্মল বায়ু আইন প্রণয়নের চেষ্টা করা হচ্ছে বহুদিন ধরে, এটির খসড়া চূড়ান্ত হয়েছে। আশা করা হচ্ছে জাতীয় সংসদের আসন্ন বা এর পরবর্তী অধিবেশনে আইনটি পাস হবে। বায়ুদূষণের জন্য অপরাধের শাস্তি হবে জেল-জরিমানা বা উভয় দণ্ড।

দেশের বাতাস নির্মল করার জন্য যেসব উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল, তার কোনোটাই আমরা তেমন দেখিনি। বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণে ধুলা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি তেমন একটা মাথায় রাখা হয়নি। যানবাহনের ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। ইটভাটা আইন কার্যকর করা নিয়ে ঢাক ঢাক গুড় গুড় ভাব আছে। সরকার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা কমানোর চিন্তা করলেও নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা সেই অর্থে এগোয়নি। পরিবেশবান্ধব পরিবহনব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়নি। খোলা জায়গার পাশাপাশি সবুজ বাড়ানোর চেষ্টা এখন পর্যন্ত মুখের কথা। বরং সবুজ কমছে, নদী-খাল, জলাশয় ও কৃষিজমি ভরাট করে রাজধানীর চারপাশে গড়ে তোলা হচ্ছে আবাসন প্রকল্প।

নির্মল বায়ু আইন পাস ও এর প্রয়োগ হওয়া সময়ের ব্যাপার। কিন্তু কোভিড–১৯ মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ দরজায় কড়া নাড়ছে। এ রোগ ও বায়দূষণ মিলে আমাদের সামনে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বাড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণ ও বায়ুদূষণ রোধের জন্য সাময়িক হলেও কিছু ব্যবস্থা এখনই গ্রহণ করতে হবে। পরিবেশ অধিদপ্তর, স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ, জনপ্রতিনিধিসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সব বিভাগকে এখনই দূষণ কমাতে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। আর পরিবেশ রক্ষায় ও দূষণ রোধে মানুষের সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই, যার বড্ড অভাব রয়েছে আমাদের।