বিদায় মিজানুর রহমান খান

সম্পাদকীয়

কোভিড-১৯ আমাদের অনেক প্রিয়জনকে কেড়ে নিয়েছে। সেই তালিকায় যুক্ত হয়েছেন আমাদের সহযোদ্ধা-সাংবাদিক ও প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান। তাঁকে এভাবে হারাতে হবে, সেটা ছিল আমাদের ভাবনার বাইরে। ডিসেম্বরের শুরুতে যখন তাঁর করোনা ধরা পড়ে, তখনো আমাদের দৃঢ় ধারণা ছিল, করোনায় আক্রান্ত অন্যান্য সহকর্মীর মতো তিনিও ফিরে আসবেন। আবার তাঁর ক্ষুরধার লেখনীতে ঋদ্ধ হবে প্রথম আলো, আলোকিত ও আলোড়িত হবে সব পাঠক। কিন্তু গত সোমবার সন্ধ্যা ৬টা ৫ মিনিটে শুনতে হলো সেই কঠিন সংবাদ—মিজানুর রহমান খান আর নেই। মাত্র ৫৩ বছর বয়সে তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। এ মৃত্যু তাঁর স্বজনদের জন্য অসহনীয়, তাঁর সহকর্মীদের জন্য বেদনার এবং বাংলাদেশের সাংবাদিকতার জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।

মিজানুর রহমান খানের সাংবাদিকতা জীবন তিন দশকের বেশি। ছাত্রাবস্থায় যিনি বরিশালের স্থানীয় পত্রিকায় সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি নিয়েছিলেন; নিজের মেধা, মনন ও পরিশ্রম দিয়ে অনেক জাতীয় দৈনিকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন; তিনি ছিলেন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক এবং জনপ্রিয় কলাম লেখক। মিজানুর রহমান খানের সাংবাদিকতা শুরু রিপোর্টিং দিয়ে; তাই পেশাগতভাবে যখন যে অবস্থানেই থাকুন না কেন, অনুসন্ধানী চোখ সর্বত্র আলো ফেলেছে। তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন আইনবিশেষজ্ঞ হিসেবে, যদিও তিনি পড়াশোনা করেছেন হিসাবরক্ষণ বিষয়ে। তবে সেখানেই থেমে থাকেনি তাঁর আগ্রহ ও অনুসন্ধিৎসা। কূটনৈতিক প্রতিবেদক হিসেবে তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সুলুক সন্ধান করেছেন; বাংলাদেশের ওপর সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর বোঝা চাপলে তিনি দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করে সমস্যাটি পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন, ছুটে গিয়েছিলেন মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সেমিনারে।

মিজানুর রহমান খান সাক্ষাৎকারভিত্তিক সাংবাদিকতাকে নিয়ে গেছেন অতি উচ্চ স্তরে। তিনি যখন রাজনীতিকদের সাক্ষাৎকার নিতেন, বোঝা যেত রাজনীতির ভেতর-বাহির তাঁর জানা; তিনি যখন চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞের সাক্ষাৎকার নিতেন, মনে হতো স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে তাঁর আছে অগাধ আগ্রহ। আসলে আমাদের সাংবাদিকতার মহা দুর্দিনে মিজানুর রহমানের মৃত্যু যে শূন্যতা তৈরি করেছে, তা পূরণ হওয়ার নয়। নিয়মিত কলাম ও প্রতিবেদন লেখার পাশাপাশি তিনি ভিডিও সাংবাদিকতায়ও নিজের দক্ষতা প্রমাণ করেন। তাঁর তোলা দুই বাসের মাঝে আটকা পড়া ছিন্ন হাতের ছবি দেশের সীমা ছাড়িয়ে বিদেশেও চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। মিজানুর রহমান খান এত বিচিত্র বিষয়ে তাঁর সাংবাদিকতার ক্ষেত্রকে বিস্তৃত করেছিলেন, যার তুলনা বিরল।

সাংবাদিকতার নিত্য ব্যস্ততার মধ্যে এই প্রতিভাবান সাংবাদিক গবেষণাকাজেও প্রচুর সময় দিয়েছেন। বিশেষ করে মার্কিন মহাফেজখানা ঘেঁটে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, পঁচাত্তরের রক্তাক্ত রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, ষাট ও পঞ্চাশের দশকের রাজনীতির গতিবিধির যে দুর্লভ তথ্য-উপাত্ত বের করে এনেছেন, তা আমাদের ইতিহাসের মূল্যবান দলিল। সাংবাদিকতায় তাঁর গভীর অনুসন্ধিৎসা আমাদের নিয়ত প্রেরণা এবং তাঁর পেশাগত সততা ও নিষ্ঠা অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

মিজানুর রহমান খান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদকই ছিলেন না, ছিলেন প্রথম আলোর অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাঁর মৃত্যুতে প্রথম আলো পরিবার গভীরভাবে শোকাহত। তাঁর পরিবারের প্রতি রইল আমাদের সহমর্মিতা ও সমবেদনা। তিনি আমাদের ছিলেন, আছেন, থাকবেন।