বিদ্যালয়ে আনন্দময় পরিবেশ

খাগড়াছড়ি জেলার খাগড়াপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যখন শ্রেণিকক্ষে ঢোকে, তখন প্রতিটি শ্রেণিকক্ষের শিক্ষক দরজার মুখে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে তাদের স্বাগত জানান; তাদের সঙ্গে কোলাকুলি করেন। বিদ্যালয়কে একটা আনন্দময় জায়গায় পরিণত করার এই প্রয়াস শিশু–কিশোরদের ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করে। ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা লক্ষ করেছেন, অভ্যর্থনা জানানোর ভঙ্গিতে শ্রেণিকক্ষের দরজায় তাঁদের দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্যটিই শিক্ষার্থীদের মুখে হাসি ফোটায়। শিক্ষক হাততালি দিয়ে তাদের স্বাগত জানাচ্ছে—শিক্ষার্থীদের জন্য এর চেয়ে আনন্দদায়ক ও উৎসাহব্যঞ্জক অভিজ্ঞতা আর কী হতে পারে।

খাগড়াপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উদ্যোগটি অভিনব। তাঁরা প্রতিটি শ্রেণিকক্ষের দরজার পাশের দেয়ালে রঙিন কাগজে আঁকা প্রতীকের ছবি সেঁটে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। সেগুলোর একটা হলো হাত, একটা হৃৎপিণ্ড বা হৃদয়, অন্যটি আঁকাবাঁক কয়েকটি রেখা (জিগজ্যাগ)। শিশু শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করার আগে যেকোনো একটা প্রতীক স্পর্শ করে। যে শিক্ষার্থী হাতের ছবি স্পর্শ করে, শিক্ষক তার হাতে হাত লাগিয়ে তালি বাজান। যে শিক্ষার্থী হৃদয়ের ছবি স্পর্শ করে, শিক্ষক তার সঙ্গে কোলাকুলি করেন। আর কেউ জিগজ্যাগ ছবিটি স্পর্শ করে, শিক্ষক তার সামনে নিজের কোমরে হাত রেখে নাচার ভঙ্গিতে অভ্যর্থনা জানান। বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক এই সুন্দর ভাবনাটি পেয়েছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চীনের একটি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অভ্যর্থনা জানানোর ভিডিও চিত্র দেখে। এ ছাড়া বিদ্যালয়ের প্রতিটি শ্রেণিকক্ষ সাজানো হয়েছে শিক্ষার নানা ধরনের উপকরণ দিয়ে। শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয় নানা ধরনের খেলার মাধ্যমে। তৃতীয় শ্রেণিতে ত্রিপুরা শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয় ত্রিপুরাদের নিজস্ব ভাষায়।

দেশের জাতীয় শিক্ষানীতিতে আনন্দময় পরিবেশে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের উপযোগী শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। দেশে খুব কম বিদ্যালয়ই রয়েছে, যেখানে আনন্দময় পরিবেশে শিশুদের পাঠদান করা হয়। বিদ্যালয় মানেই যেন শিক্ষকদের চোখরাঙানি, কড়া শাসন। এ ছাড়া রয়েছে পড়ালেখার মারাত্মক চাপ। ফলে শিক্ষা গ্রহণ শিশুদের কাছে উপভোগ্য হয়ে ওঠে না। এক গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুদের বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ বিদ্যালয়ের ভীতিজনক বা নিরানন্দ পরিবেশ।

২০১০ সালের ৯ আগস্ট দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক শাস্তি প্রদান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে পরিপত্র জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু অনেক বিদ্যালয়ে এ নিষেধাজ্ঞা মানা হয় না; শিক্ষার্থীদের ওপর শিক্ষকদের শারীরিক নির্যাতনের খবর পাওয়া যায়। শিশুদের বিদ্যালয়মুখী করতে হলে অবশ্যই বিদ্যালয়ের পরিবেশ আনন্দময় হতে হবে। এ জন্য সরকারের যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি বিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষকেও উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে খাগড়াপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে অন্যরা অনুসরণ করতে পারে।