বিপর্যয় ঠেকাতে এখনই পদক্ষেপ নিন

সম্পাদকীয়

এবার সিলেট অঞ্চলে যে ভয়াবহ বন্যা হলো, অতিবৃষ্টি ও উজানের ঢলই তার একমাত্র কারণ নয়। এক মাসের ব্যবধানে দ্বিতীয় দফা বন্যার প্রাদুর্ভাব এবং দ্রুত পানি সরে না যাওয়ার মূল কারণ নদীর তলদেশের পাশাপাশি হাওরগুলো ভরাট হয়ে যাওয়া।

গত শুক্রবার ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট আয়োজিত সেমিনারে বাংলাদেশের হাওরের যে চিত্র উঠে এসেছে, তা অতি উদ্বেগজনক। সেমিনারে উপস্থাপিত গবেষণার বিষয় ছিল, ‘হাওর এলাকার ভূমি ব্যবহারের কয়েক দশকের পরিবর্তন ও এবারের বন্যার ব্যাপকতা।’

সিলেট অঞ্চলে ব্যাপক বন্যা হয়েছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু এর কারণ কি আমরা অনুসন্ধান করে দেখেছি? এবার আসামে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশেও প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু উজানের ঢল ও বৃষ্টির পানি কেন দ্রুত সরাতে পারলাম না? বৃষ্টির পানি ধারণ করে থাকে এ অঞ্চলের হাওর, বাঁওড়, নদী-নালা, খাল ইত্যাদি।

কিন্তু গত সাড়ে তিন দশকে সেই নদী ও হাওরের চিত্র একেবার বদলে গেছে। নদীর পাশাপাশি দেশের হাওরগুলোও ভরাট হয়ে গেছে। সেমিনারে উত্থাপিত গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৮৮ সালে দেশে হাওরের আয়তন ছিল ৩ হাজার ৩৪ বর্গকিলোমিটার। ২০২০ সালে তা কমে হয়েছে ৪০৬ বর্গকিলোমিটার। এ হিসাবে হাওর কমেছে ৮৬ শতাংশ।

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে হাওর আছে সাতটি জেলায়। যথাক্রমে সুনামগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোনা, মৌলভীবাজার, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। এ হাওরের কতটা বাস্তবে আছে আর কতটা ‘ইতিহাস’ হয়ে গেছে, তা-ও বিতর্কের বিষয়।

এই ধারা চলতে থাকলে একসময় হয়তো দেশে হাওর বলতে কিছু থাকবে না। বিদ্যালয়েও এটি পঠিত হবে ‘অতীতের’ বিষয় হিসেবে। নদী ও হাওর ভরাট করার কী ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে, সেটা আমরা প্রতিবছরই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। দুর্ভাগ্য হলো তারপরও আমাদের চৈতন্যোদয় হয় না। সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনায় হাওর-নদী-বিল তথা পরিবেশ রক্ষা অগ্রাধিকার পায় না। স্বার্থান্বেষী মহল ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে এমন সব প্রকল্প নেয়, যার মূল লক্ষ্যই থাকে প্রকৃতি ও পরিবেশকে ধ্বংস করা। ‘অলৌকিকভাবে’ তা অনুমোদনও পেয়ে যায়।

প্রতিবছর হাওরের ধান রক্ষা নিয়ে আলোচনা হয়। আলোচনা হয় বাঁধ নির্মাণের নানা অনিয়ম-অসংগতি নিয়েও। কিন্তু হাওর রক্ষার জন্য কোনো আলোচনা হতে দেখি না।

এতে সরকারের মনোভাবটা স্পষ্ট। এই যে ‘উন্নয়ন দস্যুদের’ কবলে পড়ে দেশের বেশির ভাগ হাওর হারিয়ে গেল, এর কৈফিয়ত কী? হাওর উন্নয়ন বোর্ড নামে যে সংস্থাটি আছে, তারাই–বা কী করছে?

হাওর রক্ষা করতে হলে সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। বন্ধ করতে হবে হাওর দখল ও ভরাট করে যে উন্নয়ন কাণ্ড চলছে, তা-ও। মনে রাখতে হবে, কেবল ধান ও মাছের জন্যই হাওর নয়, আমাদের প্রকৃতি ও প্রতিবেশ রক্ষা করতেও হাওরের গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। নদীর মতো হাওরও একটি জীবন্ত সত্তা। সরকার যদি হাওরকে ধ্বংস করতে দিতে না চায়, তাহলে তাদের উচিত এখনই এর রক্ষায় কার্যকর ও টেকসই পদক্ষেপ নেওয়া।