বুয়েটে আবরার ফাহাদ হত্যা

বাক্স্বাধীনতার প্রশ্নে বুয়েটের মতো প্রতিষ্ঠানে নৃশংস হত্যার ঘটনায় আমরা স্তম্ভিত। এর নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই। বুয়েটের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাঁদেরই সহপাঠী তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করেছেন। মনুষ্যত্ব ও মানবিকতার লেশমাত্র থাকলে কেউ এভাবে একজন সহপাঠীকে হত্যা করতে পারেন না।

গত রোববার রাত ৮টায় শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষের বাসিন্দা আবরার ফাহাদকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে নিয়ে যান এবং তাঁর ফেসবুক ও মেসেঞ্জার অ্যাকাউন্ট চেক করেন বলে খবরে প্রকাশ। আগের দিন আবরার ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক, ভারতকে মোংলা বন্দর ব্যবহার, ফেনী নদীর পানি দেওয়া ও বাংলাদেশ থেকে এলপিজি গ্যাস রপ্তানি নিয়ে তাঁর মতামত প্রকাশ করেছিলেন।

ভিন্নমত বা সমালোচনা শুধু গণতন্ত্র নয়, সভ্য সমাজেরও অপরিহার্য অংশ। আমরা যদি নিজেদের সভ্য বলে দাবি করি, তাহলে অন্যের মত শুনতে হবে। অন্যকে কথা বলার সুযোগ দিতে হবে। কারও বক্তব্য যদি রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর হয়ে থাকে, তবে যে কেউ আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্বাভাবিক মতপ্রকাশের কারণে কাউকে পিটিয়ে হত্যা করা কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে অচিন্তনীয়। প্রতীয়মান হচ্ছে যে ফেসবুকে ভিন্নমত প্রকাশের কারণেই হল শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আবরারকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছেন। ধর্মের নামে জঙ্গিগোষ্ঠীর লোকজন একসময় দেশে ভিন্নমত প্রকাশকারীদের একের পর এক হত্যা করা শুরু করেছিল। ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা যদি একই কারণে সহপাঠীদের খুন করেন, তবে দুই পক্ষের মধ্যে পার্থক্য থাকে কীভাবে?

এখন জানা যাচ্ছে, ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে গরহাজির থাকা কিংবা বড় ভাইদের সালাম না দেওয়ার মতো কারণেও সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রায় নিয়মিতই নিগ্রহের শিকার হন। বুয়েট ক্যাম্পাসে সহিংস র‌্যাগিং ক্রমেই ব্যাপকতা পাচ্ছে। ক্ষমতার আশ্রয় থাকার কারণেই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা এ রকম ঔদ্ধত্য দেখানোর সাহস পাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয় বা হল প্রশাসনের কাছে নালিশ করেও কোনো লাভ হয় না। এমনকি আবরার হত্যার পরও প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রাধ্যক্ষ, উপাচার্য বা অন্য কোনো পদাধিকারী দ্রুত ঘটনাস্থলে আসার প্রয়োজন বোধ করেননি। প্রশাসনের এই অবস্থান ও মানসিকতার তীব্র নিন্দা জানাই।

আবরার হত্যার পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ভিন্নমত প্রকাশের কারণে একজন মানুষকে মেরে ফেলার অধিকার কারও নেই। কিন্তু তাঁর অজানা নয় যে যাঁরা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন, তাঁরা মঙ্গল গ্রহ থেকে আসেননি; সরকারি দলের ছত্রচ্ছায়ায়ই এই দানব তৈরি হয়েছে। তাই ‘হত্যার অধিকার নেই’ কিংবা ‘অপরাধী যেই দলেরই হোক ছাড় দেওয়া হবে না’ ইত্যাদি আপ্তবাক্য উচ্চারণ করে দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। কোনো ফৌজদারি অপরাধ সংঘটনের পর তা ধামাচাপা না দেওয়া গেলে একটা বহিষ্কারের নাটক মঞ্চস্থ হতে দেখা যায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বোঝা যায় অঙ্গসংগঠনগুলোর ওপর কার্যত কোনো ধরনের নজরদারি নেই এবং প্রকারন্তরে তাদের অনেকটা যা খুশি তাই করার লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে।

খুনের বিচার হোক, খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি হোক, এটা সবার মতো আমাদেরও দাবি। তবে যে দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি সারা দেশে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে, তার অবসান হওয়া জরুরি। ছাত্ররাজনীতির নামে শিক্ষাঙ্গনে এই ঘৃণ্য তৎপরতা চলতে দেওয়া যায় না। গত দুই দিনে বুয়েটের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সারা দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষের কণ্ঠে সেই দাবিই উচ্চারিত হয়েছে।