বেতনহীন ১৩ মাস

যে মধ্যম মেধার ধ্যানধারণার ওপর ভিত্তি করে পাঠদান এবং পাস করানোর সংকীর্ণ গণ্ডিতে শিক্ষাকে দেখতে সবাই অভ্যস্ত, সেই একই ধ্যানধারণার ওপর ভিত্তি করে সমাজে আদর্শ শিক্ষকের অলিখিত সংজ্ঞা দাঁড় করানো হয়েছে। সেই সংজ্ঞায় আদর্শ শিক্ষক বলতে যাঁকে নির্দেশ করা হয়, তিনি বলতে গেলে বৈষয়িক অভাব-অভিযোগের প্রায় ঊর্ধ্বে থাকা ত্রুটিবিহীন এক অতিমানব, ক্ষুধা-তৃষ্ণার মতো জাগতিক মোহ তাঁকে প্রলুব্ধ করতে পারে না। শিক্ষক সম্পর্কে এই অদৃশ্য মহামানবীয় অবয়ব সেই ‘বর্ণ পরিচয়’–এর সন্ধিক্ষণ থেকে বাঙালির মননে-চেতনে-স্বপনে রুয়ে দেওয়া হয়। সে কারণেই সমাজ শিক্ষকের দারিদ্র্য ও অভাবকে দূরীভূত না করে অমূল্য অলংকারজ্ঞানে সংরক্ষণ করে এসেছে। যখনই শিক্ষকেরা একটু বৈষয়িক স্বাচ্ছন্দ্যের সলজ্জ অভিলাষ প্রকাশ করেছেন, তখনই তাঁদের শিক্ষাদানের মানসিকতা যথার্থতা নিয়ে সরকারি-বেসরকারি মহলে প্রশ্ন উঠেছে। এই চর্চার কারণেই শিক্ষকদের অভাব-অভিযোগের খবর যথার্থ দৃষ্টি আকর্ষক পরিসরে প্রকাশ পায় না।

চাঁদপুরের মতলব উত্তর ও মতলব দক্ষিণ—এই দুই উপজেলার বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর প্রায় ১ হাজার ৪০০ শিক্ষকের ১৩ মাস ধরে বেতন না পাওয়া এবং টিউশনি বন্ধ থাকার খবর তাঁদের আদর্শ শিক্ষকের মহিমা কতখানি দিয়েছে, তা স্পষ্ট না করলেও এই ধারাবাহিক আর্থিক অপ্রাপ্তি তাঁদের দারা-পুত্র-পরিবারকে যে অনাহার-অর্ধাহারে রাখছে, সন্দেহ নেই।

খবরে এসেছে, মতলব উত্তরে ৯০টি কিন্ডারগার্টেনে শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা ৯০০ আর দক্ষিণে ৪৫টি কিন্ডারগার্টেনে শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা ৫ শতাধিক। এত দিন বেতন ও টিউশনির সুযোগ বন্ধ থাকলেও সরকারের পক্ষ থেকে তাঁদের জন্য অর্থ বা খাদ্যসহায়তা দেওয়া হয়নি। এসব পরিবার দুর্বিষহ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে পেশা পরিবর্তনের কথা ভাবছেন অনেক শিক্ষক। ঘরভাড়া দিতে না পেরে বেশ কিছু কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু চাঁদপুরে যে এই ছবি দেখা যাচ্ছে, তা কিন্তু নয়। গোটা দেশের বেসরকারি পর্যায়ের শিক্ষকেরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

বেসরকারি পর্যায়ের শিক্ষকদের এই অবস্থাকে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সরকারকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। ‘শিক্ষকেরা মানুষ গড়ার কারিগর’–জাতীয় গুটিকয় শিষ্টবাক্য নিক্ষেপ, অতঃপর বিস্মৃতি—এই চিরায়ত অনুসৃত নীতি শিক্ষকদের ক্ষেত্রে আরোপ করার ফল দীর্ঘ মেয়াদে সুখকর হবে না। কারণ, এই নিষ্ঠুর ঔদাসীন্যের কারণেই নাগরিকদের শিক্ষকতা পেশায় আসার ইচ্ছা ক্রমেই কমে আসছে। শিক্ষকতা যদি অবৈতনিক কিঙ্করতার আরেক নাম হয়, তাহলে এই পেশাকে মহান ও স্বর্ণালি ভাবার কোনো কারণ আছে কি?