ভূমধ্যসাগর ট্র্যাজেডি

লিবিয়া থেকে অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে নৌকা ডুবে যে ৬০ জন মানুষের মৃত্যু ঘটেছে, তাঁদের মধ্যে ২৭ জন বাংলাদেশি বলে নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। এই বাংলাদেশিরা সহায়সম্পত্তি বিক্রি করে জীবিকার সন্ধানে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন। এই সংবাদ আমাদের শুধু ব্যথিত করে না, ভীষণ উদ্বিগ্ন করে। যেসব পরিবারের সদস্য এই মর্মান্তিক মৃত্যুর শিকার হলেন, তাদের সমবেদনা জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই।

গত বৃহস্পতিবার রাতে লিবিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় জুয়ারা উপকূল থেকে একটি বড় নৌকা ইতালির উদ্দেশে যাত্রা করেছিল। গভীর রাতে ভূমধ্যসাগরে তিউনিসিয়ার জলসীমায় ওই বড় নৌকা থেকে প্রায় ৭৫ জনকে একটি ছোট নৌকায় নামানো হয়। তিউনিসীয় পুলিশের ভাষ্যমতে, ওই অভিবাসীদের বাতাসভর্তি ছোট একটি নৌকায় গাদাগাদি করে তোলার ১০ মিনিটের মধ্যে সেটি ডুবে যায়। উদ্ধার হওয়া ১৭ জনের মধ্যে এক শিশুসহ ১৪ জনই বাংলাদেশি। নৌকাটি ডুবে যাওয়ার পর থেকে তাঁরা প্রায় আট ঘণ্টা ঠান্ডা পানিতে ভেসেছেন।

ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের তিন মাসে লিবিয়া থেকে সাগরপথে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন—এমন অভিবাসীদের
প্রতি তিনজনের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়েছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে গত শুক্রবার পর্যন্ত ১৭ হাজার অভিবাসী ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে পৌঁছেছেন। এই যাত্রাপথে প্রায় ৫০০ অভিবাসীর মৃত্যু হয়েছে। গত বছরের দ্বিতীয়ার্ধে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে পৌঁছানো অভিবাসীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশি রয়েছেন।

কী ভয়ংকর ঘটনা! দেশি-বিদেশি দালাল চক্র গভীর সমুদ্রে একটি ছোট্ট নৌকায় এত বিপুলসংখ্যক মানুষকে তুলে দিয়েছে। নৌকাটি গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে কি না, যাত্রীরা বেঁচে থাকবেন কি না, সেসব নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথাই ছিল না। এই দালাল চক্রের একমাত্র লক্ষ্য অর্থ উপার্জন। সমুদ্রে যাত্রার আগে লিবিয়ার একটি অস্বাস্থ্যকর ঘরে তিন মাস গাদাগাদি করে তঁাদের রাখা হয়েছিল। এটি মানবতার প্রতি চরম অবমাননা। যেসব দেশে বেকারত্ব বেশি সেসব দেশকে যে এই দালাল চক্র লক্ষ্যবস্তু করে, ভূমধ্যসাগরে ডুবে যাওয়া নৌকার আরোহীদের পরিচয়ই তার প্রমাণ।

এভাবে সমুদ্রে নৌকা ডুবে বাংলাদেশি অভিবাসীদের মৃত্যুর ঘটনা প্রথম নয়। কয়েক বছর আগে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পথে বহু বাংলাদেশি সাগরে ডুবে মারা গেছেন। আর শুধু সমুদ্রপথ নয়, দুর্গম মরুপথে, তুষারপথে ও বনজঙ্গল পার হতে গিয়েও অনেকে মারা গেছেন। যাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছান, তাঁদেরও হয় পালিয়ে থাকতে হয়, কিংবা ঠাঁই হয় কারাগারে।

কেন বারবার এই দুর্ঘটনা ও মৃত্যু? যারা ভাগ্যান্বেষী তরুণদের সোনার হরিণের খোয়াব দেখিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিল, তারা প্রায়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। তাদের নেটওয়ার্ক অনেক বেশি বিস্তৃত। এই চক্রের শিকড় উৎপাটন করতে না পারলে সমুদ্রে বা মরুপথে মানুষের মৃত্যুস্রোত ঠেকানো যাবে না। ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে বাংলাদেশি নাগরিকদের মৃত্যুর খবর আসার পরপরই সিলেটের একটি আদম ব্যাপারী প্রতিষ্ঠানের লোকজন অফিস তালাবদ্ধ করে চম্পট দিয়েছেন। যেকোনো মূল্য এদের খুঁজে বের করে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।

এ ধরনের মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ও মৃত্যু এড়াতে হলে ভাগ্যান্বেষী তরুণদের যেমন সচেতন হতে হবে, তেমনি সরকারকেও তৎপর থাকতে হবে, যাতে দেশি-বিদেশি দালালেরা নিরীহ মানুষকে প্রতারিত করতে না পারে। যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বিদেশে পাঠানোর নাম করে বেকার ও অসহায় তরুণদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে শুধু দালালদের পাকড়াও করলেই এই সমস্যার সমাধান হবে না। এর স্থায়ী ও টেকসই প্রতিকার পেতে হলে দেশের ভেতরেই তরুণদের উপযুক্ত কাজের সংস্থান করতে হবে।