ভোলায় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা

ফেসবুকে মহানবী (সা.)–কে নিয়ে কটূক্তির প্রতিবাদে ভোলার বোরহানউদ্দিনে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশকে কেন্দ্র করে পুলিশের গুলিতে চার ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনাটি অত্যন্ত মর্মান্তিক। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দাবি করেছে, তারা আত্মরক্ষার্থে গুলি চালিয়েছে। কিন্তু স্থানীয়দের অনেকেই মনে করেন, পুলিশ পরিস্থিতির গভীরতা বিবেচনায় নিয়ে আরও সতর্কতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে এগোলে এত বড় অঘটন এড়ানো অসম্ভব হতো না। 

পুলিশ প্রশাসন বিক্ষোভ প্রশমনে দুই ইমামের সঙ্গে বৈঠক করে পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি স্থগিত করতে রাজি করিয়েছিল, এটি খুবই ইতিবাচক। কিন্তু উচিত ছিল সিদ্ধান্তটি স্থানীয় বাসিন্দাদের উদ্দেশে প্রচারের ব্যবস্থা করা। প্রয়োজনে তারা মাইকিং করে, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও আলেম সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠকে করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার উদ্যোগ নিতে পারত। 

ঘটনার সূচনা হয় গত শুক্রবার বিপ্লব চন্দ্র নামের এক যুবকের ফেসবুক আইডি হ্যাক ও সেই আইডিতে মহানবী (সা.)–এর প্রতি কটূক্তি করে দেওয়া একটি পোস্টকে কেন্দ্র করে। এতে স্থানীয় মুসল্লিরা ক্ষুব্ধ হন এবং রোববার বেলা ১১টার দিকে বোরহানউদ্দিন ঈদগাহ মাঠে সর্বস্তরের তৌহিদী জনতার ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করেন। কিন্তু তার আগেই বিপ্লব চন্দ্র নামের ওই যুবক এই বলে থানায় জিডি করেছেন যে তাঁর ফেসবুক আইডি হ্যাক করা হয়েছে। পুলিশ তাঁকে আটক করার পাশাপাশি হ্যাক করার সন্দেহে দুই ব্যক্তিকে আটকও করেছে। এরপর কর্মসূচি অব্যাহত রাখার যুক্তি ছিল না। 

কিন্তু এরপরও কেন সমাবেশের উদ্যোগ নেওয়া হলো ও জমায়েতের চেষ্টা হলো, সেটা এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এ ধরনের পরিস্থিতিতে স্বার্থান্বেষী মহল সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে এবং এ ক্ষেত্রেও তা ঘটে থাকতে পারে। তবে ঘটনার পর স্থানীয় সাংসদ, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আন্দোলনকারী সর্বদলীয় মুসলিম ঐক্য পরিষদের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে যেসব সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা ইতিবাচক। আমরা আশা করছি, এই সমঝোতা সেখানকার পরিস্থিতিকে সামাল ও শান্ত করতে ভূমিকা রাখবে। এই বৈঠকে ‘সর্বদলীয় মুসলিম ঐক্য পরিষদ’ উত্থাপিত যে ছয় দফা দাবি প্রশাসন নীতিগতভাবে মেনে নিয়েছে, যার মধ্যে আছে জেলা ও থানা থেকে এসপি এবং ওসিদের প্রত্যাহার; ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ দাফন করার অনুমতি; আহত লোকজনের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা; নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে আর্থিক সাহায্য দান; ঘটনার সময় আটক ব্যক্তিদের মুক্তি ও অপরাধীদের শাস্তিদান। এর মধ্যে প্রথম পাঁচ দফা দাবি প্রশাসনই বাস্তবায়ন করতে পারে। বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে সংঘটিত ঘটনায় পুলিশের দায় কতটা ছিল, তার চেয়েও জরুরি বিবেচ্য হলো, দ্রুত সেখানে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরিয়ে আনা এবং স্থানীয়দের ক্ষোভ প্রশমন করা। 

প্রশাসন এ বিষয়ে যত দ্রুত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেবে, তত স্থানীয় মানুষের আস্থা ফিরে পাবে। চারজন মানুষ নিহত হওয়ার ক্ষতি অপূরণীয়। তারপরও যদি তাঁদের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা হয়, সেটি স্বজনদের জন্য সান্ত্বনা হয়ে থাকবে। এর আগে কক্সবাজারের রামুতে ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দুই যুবকের ফেসবুক আইডি হ্যাক ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের চেষ্টা করেছিল কুচক্রী মহল। আমরা আশা করব, ভোলায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ দ্রুত ফিরে আসবে এবং ধর্মনির্বিশেষে প্রতে্যক নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রশাসন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। 

একই সঙ্গে এই ঘটনার একটি সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত প্রয়োজন। ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি ও পুলিশ প্রশাসনের তরফে উদ্যোগের পরও কেন পরিস্থিতি সামাল দেওয়া গেল না, তা খুঁজে বের করা জরুরি। কোনো পক্ষের ইন্ধন এ ক্ষেত্রে কাজ করে থাকলে, তাদের চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।