ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা

ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে ‏ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার মন্দবাগ রেলস্টেশনে সংঘটিত ট্রেন দুর্ঘটনাটি আমাদের রেলওয়ে ব্যবস্থার বিবর্ণ ও বেহাল চিত্রই তুলে ধরেছে। এই দুর্ঘটনায় ১৬ জন নিহত হয়েছেন। আহত শতাধিক, যাদের অন্তত ১৫ জনের অবস্থা গুরুতর। 

যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে মানুষ এই ভেবে সান্ত্বনা খোঁজে যে এর ওপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। কিন্তু মন্দবাগ রেলস্টেশনের দুর্ঘটনা অনেকটাই মনুষ্যসৃষ্ট। রেলওয়ে স্টেশনের মাস্টার মো. জাকের হোসেন চৌধুরীর ভাষ্য অনুযায়ী, তূর্ণা নিশীথা ট্রেনটিকে আউটারে মেইন লাইনে থামার জন্য সিগন্যাল দেওয়া হলেও ট্রেনের চালক তা শোনেননি। উদয়ন ট্রেনটি মেইন লাইন থেকে ১ নম্বর লাইনে প্রবেশের মুহূর্তে উল্টো দিক থেকে নিশীথা ট্রেনটি এর ওপর এসে পড়ে। এতে উদয়নের কয়েকটি বগি দুমড়েমুচড়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, দুর্ঘটনাকবলিত বগিগুলো ২০ ফুট পর্যন্ত ওপরে উঠে যায়। সে ক্ষেত্রে এসব বগিতে থাকা যাত্রীদের কী অবস্থা হতে পারে, অনুমান করা কঠিন নয়। 

অন্যান্য দুর্ঘটনার পর যেমনটি হয়ে থাকে মন্ত্রী ঘটনাস্থলে যান, রেলওয়ের বড় কর্তাব্যক্তিরা যান, তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, এ ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। দুর্ঘটনার পর রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম ঘটনাস্থলে গিয়ে বলেছেন, তূর্ণা নিশীথার চালকের সিগন্যাল না মানার কারণে দুর্ঘটনা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়। দায়িত্বে অবহেলার জন্য তূর্ণা নিশীথার লোকোমাস্টার, সহকারী লোকোমাস্টার ও এক গার্ডকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। ট্রেন দুর্ঘটনার কারণ খুঁজে বের করতে পাঁচটি কমিটি গঠন ছাড়াও সরকার প্রত্যেক নিহত ব্যক্তির পরিবারকে ১ লাখ টাকা ও আহত ব্যক্তিদের ১০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা জানিয়েছেন মন্ত্রী।

যেকোনো দুর্ঘটনার পর কর্তৃপক্ষকে নড়েচড়ে বসতে দেখা যায়। অনেকগুলো তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তারপর সব তৎপরতা থেমে যায়। দুর্ঘটনার কারণ বিবেচনায় নিয়ে ভবিষ্যতের সতর্কতার দিকটিও মেনে চলা হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাউকে জবাবদিহিও করতে হয় না। এসব কারণেই গত সাড়ে ১০ বছরে ৪ হাজার ৭৯৮ বার ট্রেন দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে, প্রাণহানি হয়েছে ৪০৮ জনের। গত ২৩ জুন রাতে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় উপবন ট্রেনের ছয়টি বগি লাইনচ্যুত হলে চারজনের প্রাণহানি ঘটে। সে সময় রেলমন্ত্রী ট্রেনে বাড়তি যাত্রী ওঠাকে কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। কিন্তু এবার দুর্ঘটনার ব্যাখ্যা কী? রেলওয়েতে ট্রেনের লাইনচ্যুতি, ভুল সিগন্যাল, গার্ডের গাফিলতি এখন নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম-নাজিরহাট রেলপথে জুনায়েদ নামের এক গার্ড আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়ায় প্রায় এক ঘণ্টা যাত্রীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। 

পৃথিবীর সব দেশেই ট্রেনযাত্রাকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ বাহন হিসেবে ভাবা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে সড়ক পরিবহন ব্যবসার প্রসারের স্বার্থে একটি স্বার্থান্বেষী মহলের কারণে রেলওয়ে অবহেলিত থেকে গেছে বলে অভিযোগ আছে। একসময় এই মন্ত্রণালয়ের পৃথক সত্তাই মুছে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকার আলাদা রেলওয়ে মন্ত্রণালয়কে পুনরুজ্জীবিত করলেও যাত্রীসেবা ও নিরাপত্তা দুটোই ভঙ্গুর অবস্থায় আছে। 

বর্তমান রেলমন্ত্রী আমাদের অনেক স্বপ্নের কথা শুনিয়েছেন, কিন্তু সামগ্রিকভাবে রেলওয়ে ব্যবস্থার এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। অন্যদিকে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। রেলওয়ের যঁাদের খামখেয়ালির কারণে ১৬ জন মানুষের জীবনহানি ঘটল, যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে তাঁদের চিহ্নিত করে নিয়ম অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা আশা করব এই দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে রেলওয়ের কর্তৃপক্ষ ভবিষ্যতে যথাযথ সতর্কতা পালন করবে। কারণ, যেকোনো অসতর্কতা বা অবহেলার পরিণতি কী হতে পারে, এ দুর্ঘটনা আমাদের তা দেখিয়ে দিয়েছে। নিহত সবার পরিবারের প্রতি রইল আমাদের শোক ও সমবেদনা।