মজুরিতে পিছিয়ে বাংলাদেশ

বাংলাদেশের শ্রমিকেরা তুলনামূলক উৎপাদন বেশি করেন, অথচ মজুরি পান সবচেয়ে কম। এ তথ্য আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও)। গত বুধবার প্রকাশিত সংস্থার গ্লোবাল ওয়েজ রিপোর্ট-২০২০-২১-এ জানানো হয়, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ন্যূনতম মজুরিতে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশের ন্যূনতম মজুরি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত দারিদ্র্যসীমার নিচে। ক্রয়ক্ষমতার বিবেচনায় ২০১৯ সালে বাংলাদেশের মাসিক ন্যূনতম মজুরি ছিল ৪৮ ডলার। তবে তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকেরা এর দ্বিগুণ মজুরি পাচ্ছেন বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়।

বাংলাদেশে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নেই। নির্দিষ্ট কিছু খাতের জন্য পৃথক মজুরিকাঠামো আছে। অদক্ষ ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের মজুরি বিবেচনা করে এই হিসাব দিয়েছে আইএলও। মজুরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তুলনায় পাকিস্তানের শ্রমিকেরা তুলনামূলক ভালো অবস্থায় আছেন। ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে পাকিস্তানের মাসিক ন্যূনতম মজুরি ৪৯১ ডলার, দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ।

এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাংলাদেশের শ্রমিকেরা যেখানে সবচেয়ে কম মজুরি পান, সেখানে উৎপাদনশীলতায় বেশ এগিয়ে আছেন তাঁরা। এ অঞ্চলের শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতার প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি মিয়ানমারে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ। এরপর যথাক্রমে বাংলাদেশ ৫ দশমিক ৮ শতাংশ, পাকিস্তান ২ দশমিক ২, নেপাল ৪ দশমিক ৩, শ্রীলঙ্কা ৪ ও আফগানিস্তান ১ দশমিক ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।

আশার কথা, বাংলাদেশের শ্রমিকেরা কম মজুরি পেয়েও বেশি উৎপাদন করেন। মজুরি বাড়লে উৎপাদনশীলতা আরও বাড়বে—এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। অতএব সরকার ও মালিকপক্ষের উচিত মজুরির বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা। বেশি মজুরি দিলে শ্রমিকেরা আরও বেশি কাজ করবেন, তাতে শিল্প ও মালিক লাভবান হবেন। কম মজুরি দিয়ে বেশি লাভ করার প্রবণতা মালিকদের পরিহার করতে হবে।

আইএলওর হিসাব অনুযায়ী, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি মজুরি দেয় অস্ট্রেলিয়া। ২০১৯ সালে ক্রয়ক্ষমতার বিবেচনায় দেশটিতে ন্যূনতম মজুরি ছিল ২ হাজার ১৬৬ ডলার। এই অঞ্চলের গড় মাসিক মজুরি ৩৮১ ডলার। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উন্নত দেশ। এই দেশগুলোর মজুরি অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি। বাংলাদেশের শ্রমিকেরা উন্নত দেশের শ্রমিকদের সমান মজুরি পাবেন, সেই দাবি হয়তো ঠিক নয়। কিন্তু তাঁরা পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার শ্রমিকদের সমান বা কাছাকাছি মজুরি কেন পাবেন না?

আইএলওর প্রতিবেদনে তৈরি পোশাকশিল্পের মজুরি মোটামুটি সন্তোষজনক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু অক্সফামের প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে তৈরি পোশাকশিল্পে মজুরি অন্যান্য দেশের তুলনায় সবচেয়ে কম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে বসবাসের জন্য শোভন মজুরি প্রয়োজন ২৫২ মার্কিন ডলারের সমান অর্থ। এর বিপরীতে বাংলাদেশের একজন শ্রমিক পান ৫০ ডলার। ভারত ও শ্রীলঙ্কার শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৫০ ডলার। তবে ভারতে শোভন জীবনযাপনের জন্য ২০০ ডলার এবং শ্রীলঙ্কায় ২৫০ ডলারের বেশি অর্থ দরকার হয়।

আইএলওর এই হিসাব ২০১৯ সালের। কিন্তু ২০২০ সালে করোনাকালে বাংলাদেশের শ্রমিকদের অবস্থা আরও নাজুক হয়েছে। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। অনেকের মজুরি কমে গেছে। প্রাতিষ্ঠানিক খাতের চেয়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকেরা আরও বেশি নাজুক অবস্থায় চলে গেছেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মনে রাখতে হবে, কম মজুরি দিয়ে বেশি কাজ পাওয়া যাবে না। শিল্প ও দেশের টেকসই উন্নয়নও আশা করা যায় না।