মহামারিকালে নববর্ষ

ঠিক এক বছর আগে এই দিনে আমরা লিখেছিলাম, এবারের পয়লা বৈশাখ এল বড় এক জাতীয় দুর্যোগের মধ্যে। কোভিড-১৯ নামের এক নতুন ভাইরাস মহামারি আকারে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। ওই সময় পর্যন্ত বাংলাদেশে এই রোগে মারা গিয়েছিলেন ৩৯ জন, সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছিল ৮০৩ জনের। আর এক বছরের মাথায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৮৯১; মোট সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে ৬ লাখ ৯৭ হাজারের বেশি মানুষের মধ্যে। ইতিমধ্যে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়ে গেছে; প্রতিদিন গড়ে ৭ হাজারের বেশি সংক্রমণ শনাক্ত হচ্ছে, মারা যাচ্ছেন গড়ে ৭০ জনের বেশি মানুষ। রোগীর সংখ্যা হঠাৎ ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালগুলোতে চাপও বেড়েছে।

করোনা সংক্রমণ রোধ করার লক্ষ্যে গত বছরের এই সময়ে লকডাউন চলছিল; এবারও আজ থেকে লকডাউনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সরকার নানাভাবে জনসমাগম কমানোর চেষ্টা করছে; এই লকডাউন তারই একটা অংশ। তবে অতিরিক্ত জনঘনত্বের এই দেশে ফলপ্রসূ লকডাউন কতটা সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বিপুলসংখ্যক মানুষ জীবিকার সংকটে পড়েছেন। এক বছরের বেশি সময় ধরে নিম্ন আয়ের মানুষের কষ্ট হচ্ছে; তাঁদের জীবনমান ইতিমধ্যে অনেক কমেছে। নতুন দরিদ্র তালিকায় যুক্ত হয়েছেন অনেক মানুষ। একদিকে প্রতিদিন আরও বেশিসংখ্যক মানুষের মৃত্যু, আরও বেশি সংক্রমিত হওয়া, হাসপাতালে হাসপাতালে চিকিৎসার চাপ, অন্যদিকে জীবিকার সংকট—এই অবস্থার মধ্যে এসেছে নববর্ষ। কিন্তু এখন আমাদের আনন্দ-উৎসব উদ্‌যাপনের সুযোগ নেই। তবু ১৪২৮ বঙ্গাব্দের এই প্রথম প্রভাতে আমরা সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই, সবার সুস্থতা কামনা করি। কেননা, পয়লা বৈশাখ আসে নতুন আশা, নতুন স্বপ্ন, নতুন প্রত্যয় নিয়ে।

পয়লা বৈশাখের উৎসবের প্রধান বৈশিষ্ট্য এর সর্বজনীনতা। করোনা দুর্যোগের এই সময়ে এই সর্বজনীনতার প্রকাশ ঘটুক জাতীয় ঐক্য, সংহতি, সহমর্মিতার মধ্য দিয়ে। এই গভীর সংকট মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন সবার দায়িত্বশীলতা ও পারস্পরিক সহযোগিতা। সংক্রমণের ঝুঁকি থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার প্রয়াসের মধ্য দিয়ে আমরা অন্যদেরও সেই ঝুঁকির বাইরে রাখতে পারি। তাই ঘোষিত লকডাউন চলাকালে এবং তারপরও জনসমাগম যথাসম্ভব এড়িয়ে সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সারা, মুখে মাস্ক পরা, ঘন ঘন হাত ধোয়াসহ স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে মেনে চলার চেষ্টা করতে হবে সবাইকে। সরকারের পক্ষ থেকে যে ১৮ দফা নির্দেশনা জারি করা হয়েছে, সবাইকে সেগুলো যথাযথভাবে মেনে চলার চেষ্টা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সরকারি নির্দেশনাগুলোর চূড়ান্ত লক্ষ্য প্রত্যেক ব্যক্তির স্বাস্থ্যগত সুরক্ষা নিশ্চিত করা। আমার সুরক্ষার ওপর অন্যদের সুরক্ষা নির্ভরশীল, তাই প্রত্যেকের দায়িত্বশীল আচরণও সংক্রমণ রোধ করার সর্বোত্তম পন্থা।

সংক্রমণ রোধের সর্বাত্মক চেষ্টার পাশাপাশি কোভিডে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জীবন রক্ষার জন্য চিকিৎসাব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনার সামগ্রিক উন্নতির ওপর বিশেষ জোর দিতে হবে। যেহেতু গুরুতর রোগীর সংখ্যা এখন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি, তাই অক্সিজেন সরবরাহ ও আইসিইউ সুবিধা সম্প্রসারণেরও জোরালো উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনে নতুন করে সংকট সৃষ্টি হয়েছে; বর্ষবরণের দিনে তাদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত। সমাজের সামর্থ্যবান ব্যক্তি, সংস্থা, প্রতিষ্ঠানগুলো সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে, পারস্পরিক সংস্পর্শ যথাসম্ভব এড়িয়ে ক্ষুধার্ত মানুষদের, বিশেষত শিশুদের খাদ্য সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নিতে পারেন।

নববর্ষের এই দিনে আমরা করোনাভাইরাসের আক্রমণ থেকে সারা পৃথিবীর মানুষের আশু মুক্তি কামনা করি। এই দুঃসময় দূর হোক।