মাতৃসেবায় লোকবলের ঘাটতি

স্বাধীনতার সময়কার সঠিক হিসাব আমাদের কাছে নেই। তবে নানা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ধারণা করা হয়, সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে প্রতি লাখে তখন মারা যেতেন ৬০০ মা। ৫০ বছর পর এখন মারা যান ১৬৫ জন। অর্থাৎ প্রসবকালে মাতৃমৃত্যু কমেছে তিন গুণের বেশি। সন্দেহ নেই, এটা বেশ অগ্রগতি। তারপরও ১৬৫ সংখ্যাটা উপেক্ষণীয় নয়। এই মাতৃমৃত্যুর প্রধান একটা কারণ, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত ধাত্রীর অভাব।

একটা হিসাব দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। আন্তর্জাতিক ধাত্রী দিবসে ‘দ্য স্টেট অব দ্য ওয়ার্ল্ডস মিডওয়াইফারি ২০২১’ শীর্ষক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে যৌথভাবে হিসাবটা দিয়েছে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আর ইন্টারন্যাশনাল কনফেডারেশন অব মিডওয়াইভস। ২০১৯ সালে বাংলাদেশে প্রায় ২৯ লাখ শিশু জন্ম নিয়েছে। এর মধ্যে ৫৩ শতাংশের জন্মের সময় মায়ের পাশে দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী ছিলেন। তার মানে ৪৭ শতাংশই, সংখ্যার হিসাবে যা প্রায় ১৪ লাখ, দক্ষ কোনো ধাত্রীর সহায়তা ছাড়া এই দুনিয়ার মুখ দেখেছে। জন্মের সময় কোনো জটিলতা দেখা দিলে সামলানোর মতো মানুষ এসব অসহায় মায়ের পাশে ছিল না।

বাংলাদেশে প্রতি লাখ মানুষের জন্য এখন কতজন ধাত্রী আছেন, জানেন? সর্বশেষ ২০১৯ সালের উপাত্ত অনুযায়ী মাত্র তিনজন। পেশাদার ধাত্রী মাত্র ৪ হাজার ৩৯৬ জন আর সহযোগী ৭ হাজার ২০২ জন। বিপরীতে প্রজননক্ষম নারী আছেন প্রায় ৪ কোটি ৫৭ লাখ আর গর্ভধারণ করেছেন প্রায় ৪৩ লাখ। মোট ধাত্রীসংখ্যার বিপরীতে এই সংখ্যাগুলোকে দাঁড় করালেই বোঝা যায়, এই খাতে আমাদের জনবল কত ভয়াবহ রকমের কম।

সরকার প্রশিক্ষিত ধাত্রী তৈরির লক্ষ্যে ২০১৩ সালে তিন বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন মিডওয়াইফারি কোর্স চালু করে। এর আগে ধাত্রীবিদ্যা শেখানোর জন্য বাংলাদেশে ছয় মাসের একটি কোর্স ছিল। ১৮ মাসের বৈশ্বিক মানদণ্ডের বিপরীতে এই কোর্স পর্যাপ্ত ছিল না। ডিপ্লোমা কোর্সের আওতায় এখন প্রতিবছর সরকারি নার্সিং কলেজগুলো থেকে প্রায় এক হাজার ধাত্রী বের হন, বেসরকারি পর্যায়ে বের হন আরও এক হাজার। এই সংখ্যা চাহিদার তুলনায় অতি অল্প। তাই ধাত্রী তৈরির সংখ্যা ও প্রতিষ্ঠান আরও বাড়াতে হবে। পাশাপাশি বন্ধ থাকা ধাত্রী নিয়োগের প্রক্রিয়া আবার চালু করা প্রয়োজন। নইলে গ্রামগঞ্জে সন্তান প্রসবকালে মায়েদের মৃত্যু কমানো যাবে না। কিন্তু এই একুশ শতকে এসব অপমৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।