মানব পাচারবিরোধী আইন

জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা যখন বাংলাদেশের মানব পাচারবিরোধী আইন ও সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রশংসা করছে, তখন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) এই আইন সংশোধনের দাবি কতটা যৌক্তিক?

বায়রার যুক্তি হলো, বৈধভাবে যাঁরা জনশক্তি রপ্তানি করেন, তাঁদের ক্ষেত্রে মানব পাচার আইন প্রয়োগ হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। একই সঙ্গে পরোয়ানা ছাড়া জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ে অভিযান ও সরঞ্জাম জব্দ করার ক্ষমতা নিয়েও আপত্তি করছেন তাঁরা। গত সেপ্টেম্বরে সংগঠনের নেতারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে তাঁদের আপত্তির কথা জানিয়েছেন।

মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে সরকার আইনি ব্যবস্থা নিলে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের বিচলিত হওয়ার কারণ নেই। কিন্তু তাঁরা বিচলিত হচ্ছেন। এর কারণ, জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের নামে সংগঠনের কেউ কেউ মানব পাচার করছেন। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, বায়রার দাবি সমর্থন করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে চিঠি দিয়েছেন। ২০১৯ সালের ২৫ জুন তৎকালীন প্রবাসীকল্যাণ প্রতিমন্ত্রীর (বর্তমানে মন্ত্রী) একটি চিঠির কথাও উল্লেখ করে তিনি আইনটি আংশিক সংশোধনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেন। কিন্তু তাঁর ভাষায় ‘কঠোর আইন’ থাকার পরও কেন মানব পাচার বন্ধ হচ্ছে না, সে বিষয়ে তিনি কিছু বলেননি।

বায়রার মহাসচিব বলেছেন, কেউ বিদেশ থেকে ফিরে অভিযোগ করলেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন অনুসরণ না করে মানব পাচার প্রতিরোধ আইনের অধীনে মামলা করে। জনশক্তি রপ্তানিকারকদের আটক করে, এরপর তাঁদের ছয়-সাত মাস জেল খেটে বের হতে হয়। এই প্রসঙ্গে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, কোনো আইনেরই অপব্যবহার কাম্য নয়। এতে আইনের যে উদ্দেশ্য, তা কেবল ব্যাহত হয় না, নিরীহ মানুষের হয়রানির শিকার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। মানব পাচার আইনের অপব্যবহার ও পুলিশের অযথা হয়রানির শিকার হয়ে থাকলে প্রতিকার হওয়া প্রয়োজন।

মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনটি হয় ২০১২ সালে। এতে অনুমোদন সাপেক্ষে (নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তার) পুলিশের উপপরিদর্শক পর্যন্ত পর্যায়ের কর্মকর্তাদের তল্লাশি করা এবং সরঞ্জাম জব্দ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। পুলিশ বিনা পরোয়ানায়ও তল্লাশি করতে পারে। শর্ত হলো, অপরাধটি প্রকৃতই সংঘটিত হওয়ার বা কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ নষ্ট হওয়ার যুক্তিসংগত কারণ থাকতে হবে।

মনে রাখতে হবে, মানব পাচারবিরোধী আইনটি জনশক্তি রপ্তানিকারকদের বিরুদ্ধে নয়, মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে। সে ক্ষেত্রে মানব পাচার আইন যত কঠোরই হোক, বায়রার উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। তারা বৈধ ব্যবসা করে।

দুর্ভাগ্যজনক যে একশ্রেণির রপ্তানিকারক বিদেশে কর্মসংস্থানের নামে মানব পাচার করে থাকেন। এঁদের খপ্পরে পড়ে বহু মানুষ বিদেশে গিয়ে দুর্বিষহ জীবন যাপন করেন। গন্তব্যে পৌঁছার আগেই অনেকে সাগরে ডুবে কিংবা মরুভূমিতে পথ হারিয়ে মারা যান। ফলে বায়রার উচিত অসাধু রপ্তানিকারকদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি সরকারের আইন প্রয়োগে সহায়তা করা।

সম্প্রতি ব্রুনেইয়ে একজন শ্রমিকের অভিযোগের কারণে শেখ আবদুর রহমান ওরফে হিমু নামের এক জনশক্তি রপ্তানিকারকের গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনায় উদ্বেগও প্রকাশ করেছে বায়রা। কিন্তু যে শ্রমিক সেখানে গিয়ে শারীরিকভাবে পঙ্গু হয়ে গেলেন, তিনি কার কাছে বিচার চাইবেন? ক্ষতিপূরণ দাবি করবেন?

আইন প্রয়োগে পুলিশ বাড়াবাড়ি করে থাকলে তার প্রতিকার আছে। আমরা মনে করি, মানব পাচার আইনের এমন কোনো সংশোধনের সুযোগ নেই যাতে পাচারকারীদের জন্য তা বাড়তি সুযোগ হিসেবে হাজির হয়।