মৎস্যজীবীদের ছয় দফা

সম্পাদকীয়

বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদ আহরণে উপকূলীয় মৎস্যজীবী বা জেলেদের অবদানই বেশি। বিশেষ করে ইলিশ আহরণ। পুকুর, ডোবা ও জলাশয় থেকে আমরা চাষের মাছ পেয়ে থাকি। কিন্তু ইলিশ ও সামুদ্রিক মাছের পুরোটাই জোগান দেন এই উপকূলীয় জেলেরা। অনেক সময় ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যে জীবন বাজি রেখেও তাঁরা নদী ও সমুদ্রে মাছ ধরেন।

প্রথম আলোর ভোলা ও পটুয়াখালী প্রতিনিধির পাঠানো খবরে জানা যায়, সেখানকার জেলেরা গভীর সমস্যায় আছেন। তাঁরা মাছের ন্যায্য দাম পান না। মোহনা ভরাট হয়ে যাওয়া ও নদীতে ডুবোচর জাগায় মাছ ধরতেও সমস্যা হয়। উপকূলে বছরে মাত্র চার মাস মাছ ধরার মৌসুম। বাকি সময় জেলেদের কার্যত বেকার থাকতে হয়। এ সমস্যার সমাধানে উপকূলীয় মৎস্যজীবীরা খাসজমি বরাদ্দ, খরা মৌসুমে উপযুক্ত সহায়তা, জীবনবিমা চালুসহ যে ছয় দফা দাবি পেশ করেছেন, তা যৌক্তিক।

ভোলা ও পটুয়াখালীর জেলেরা যেসব সমস্যার কথা বলেছেন, তা কমবেশি উপকূলের সব জেলেরই। জেলেদের নিজস্ব পুঁজি নেই। তাঁরা মহাজন ও আড়তদারদের কাছ থেকে টাকা ধার করে নদীতে নৌকা ও জাল নামান, এই সময়ে পরিবারের সদস্যদের খাবারের জোগান দেন। বিনিময়ে সেই আড়তেই কম দামে মাছ বিক্রি করতে হয় তাঁদের। বলতে গেলে জেলেদের জীবন আড়তদারদের কাছেই বাঁধা।

ইলিশসহ সব সামুদ্রিক মাছের উৎপাদন বাড়ছে, এটা আশার খবর। কিন্তু যাঁরা ঝড়ঝঞ্ঝা মোকাবিলা করে মাছ ধরেন, তাঁদের জীবন খুবই অনিশ্চিত। কখনো কখনো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। গত এক বছরে ভোলা উপকূলেই ২২ জন জেলে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছেন। ‘খরা মৌসুমে’ সরকারের পক্ষ থেকে জেলেদের যে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়, তা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম। তদুপরি বরাদ্দের একাংশ যায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালীদের পকেটে। অনেক ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্য জেলেদের চাল আত্মসাতের দায়ে জেলও খেটেছেন। তারপরও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।

এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ৩০ লাখ মৎস্যজীবী আছেন, যাঁদের সবাই নিবন্ধিত নন। ভোলা জেলায় পৌনে দুই লাখ জেলের মধ্যে নিবন্ধিত ১ লাখ ৩৬ হাজার। সে ক্ষেত্রে সব জেলেকে নিবন্ধনের আওতায় এনে আর্থিক সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন।

বাংলাদেশে মহাজনি প্রথার অবসান হয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু ব্যাংকব্যবস্থা থেকে উপকূলীয় জেলেরা কোনো ঋণ না পাওয়ায় মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হন। এ অবস্থার উত্তরণে সরকারের উচিত জেলেদের পর্যাপ্ত ঋণ দেওয়া। সে জন্য প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন নেই। মোবাইল ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে তাঁদের ঋণ দেওয়া যেতে পারে। অনেক জেলের স্থায়ী ঘরবাড়ি নেই, তাঁদের খাসজমি দেওয়া হলে খরা মৌসুমে তাঁরা কৃষিকাজ করে কিছু উপার্জন করতে পারবেন।

দেশে জনসংখ্যা ক্রমাগত বাড়লেও উপকূলীয় অঞ্চলে কমে যাচ্ছে। কিছুদিন আগে প্রথম আলোতেই এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে মাছ ধরা ছাড়া আয়ের অন্য কোনো নির্ভরযোগ্য উপায় নেই। এর প্রতিকারে সরকারকে উপকূলের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে বিশেষ নজর দেওয়া উচিত। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের মতো উপকূলীয় উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন করা যেতে পারে। জেলেদের ভাগ্যের উন্নয়ন ছাড়া মৎস্যসম্পদের উন্নয়ন টেকসই হবে না।