লকডাউনে জীবন-জীবিকা

করোনা মোকাবিলায় সোমবার থেকে সারা দেশে এক সপ্তাহের বিধিনিষেধ বা লকডাউন দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, যারা বিধিনিষেধ মানবে না, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সাম্প্রতিক কালে যে হারে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়েছে, তাতে এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার বিকল্প ছিল না। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, আরও আগে এই বিধিনিষেধ দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। মনে হচ্ছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আগাম উদ্যোগ নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের অনীহা ছিল। তারা ঘটনার পেছনে পেছনে ছোটে। এ সিদ্ধান্ত মার্চের মাঝামাঝি নিতে পারলে সংক্রমণ মোকাবিলা আরও সহজ হতো।

করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের জারি করা সাত দিনের বিধিনিষেধের সময়ে পালনের জন্য যেসব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনেক নির্দেশনা অস্পষ্ট। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে কায়দায় সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউন ঘোষণা করা হয়, সেখানে সবকিছু অবরুদ্ধ অবস্থায় বা বন্ধ থাকে। কিন্তু সরকার কিছু খোলা রাখছে, কিছু বন্ধ থাকছে। বাংলাদেশের মতো অধিক জনসংখ্যার দেশে লকডাউন হয়তো সম্ভবও নয়। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের মতে, সারা দেশে লকডাউন দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না। যেসব এলাকায় সংক্রমণ বেড়েছে, সেসব এলাকায় লকডাউন বা চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করাই জরুরি ছিল। যেমনটি গত বছর করা হয়েছিল।

সরকার বলেছে, জীবন ও জীবিকা—উভয়ই রক্ষা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে জীবনই অগ্রাধিকার পাবে। যে বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে, তার মাধ্যমে যদি সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, সেটি বড় অর্জন হবে। তবে সে জন্য সরকারকে বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নিতে হবে এবং বিষয়টিকে সামগ্রিকভাবে দেখতে হবে। বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত পদক্ষেপ কোনো কাজে দেবে না। যে দেশে এখনো প্রায় এক–চতুর্থাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, মোট শ্রমজীবী মানুষের ৮০ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন, সেখানে জীবন-জীবিকার ভারসাম্য রক্ষা করা কেবল কঠিন নয়, অত্যন্ত দুরূহ। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয়ের পথ বন্ধ হলে কী হবে, সেটা বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। তাদের জন্য কোনো ব্যবস্থা না রেখে বিধিনিষেধ কার্যকর করা অসম্ভব। ক্ষুদ্র আয়ের মানুষ ও শ্রমজীবীরা বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। নিউমার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকার হকার ও ছোট ব্যবসায়ীরা দোকান খোলার দাবিতে পথে নেমেছেন। এর আগে রাইড শেয়ারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির প্রতিবাদে মোটরসাইকেলচালকেরাও বিক্ষোভ করেছিলেন।

এক বছরের বেশি সময় ধরে করোনা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। গত বছর দীর্ঘ লকডাউন গেছে। তখন অনেকে জীবিকা হারিয়েছেন। যে দারিদ্র্যের হার ২০১৯ সালের শেষের দিকে ২০ শতাংশের মতো ছিল, সেটা বেড়ে ৪০-৪১ শতাংশ হয়ে গেছে। তার মানে, দারিদ্র্যের হার প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। নতুন কোনো চাপ নেওয়ার ক্ষমতা এই জনগোষ্ঠীর নেই। সংক্রমণ রোধে বিধিনিষেধ আরোপের সিদ্ধান্ত হয়েছে, কিন্তু দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সাহায্য-সহায়তার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।

গত সাধারণ ছুটিতে সরকার প্রান্তিক মানুষের জন্য যে বরাদ্দ দিয়েছিল, তা যথাযথভাবে তাদের কাছে পৌঁছায়নি। লাভের গুড় পিঁপড়ায় খেয়ে ফেলেছে। লকডাউন যত কম সময়ের জন্য হোক না কেন, হঠাৎ কাজ হারানো মানুষদের খাইয়ে বাঁচাতে হবে। করোনা থেকে বাঁচার চেয়ে ক্ষুধা থেকে বাঁচা কম জরুরি নয়। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। স্থানীয় সরকারগুলোর সহায়তায় দরিদ্রদের তালিকা তৈরি করে জরুরি ভিত্তিতে আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। যথাযথ তালিকা করা গেলে সেটি পাঠানোর জন্য একটি টেলিফোন নম্বরই যথেষ্ট।