শক্তি প্রয়োগ নয়, আলোচনায় বসুন

সম্পাদকীয়

নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে প্রতিবেশী ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার সামরিক অভিযানে বিশ্বের সব শান্তিকামী মানুষের সঙ্গে আমরাও গভীরভাবে উদ্বিগ্ন এবং একটি স্বাধীন দেশে এ ধরনের সামরিক অভিযান ও হামলার কঠোর নিন্দা জানাই। দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে নিরাপত্তা বা অন্য যেকোনো বিষয়ে বিরোধ দেখা দিতে পারে। কিন্তু তার সমাধানের পথ যুদ্ধ নয়। আলোচনায় বসেই সমাধানের উপায় খুঁজতে হবে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ওয়ারশ জোট ভেঙে দেওয়া হলেও ন্যাটো জোট সম্প্রসারণ করা হয়েছে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অনেক মিত্রদেশও ন্যাটোর সদস্য হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে রাশিয়া একে তার নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করতে পারে। প্রতিবেশী ইউক্রেনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটোর সদস্যদেশগুলোর রয়েছে সুসম্পর্ক। তাই বলে কোনো রাষ্ট্রের ওপর আগ্রাসী অভিযান বা হামলা করবে, তা বরদাশত করা যায় না। আজ রাশিয়া নিরাপত্তার দোহাই তুলে ইউক্রেনের ওপর হামলা করেছে, ভবিষ্যতে অন্য কোনো বৃহৎ শক্তি যদি একই যুক্তিতে রাশিয়ার কোনো মিত্রদেশের ওপর সামরিক অভিযান চালায়, তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে?

উদ্বেগের বিষয় হলো, ইউক্রেনে রাশিয়ার সেনা অভিযান কেবল সামরিক স্থাপনা ও ঘাঁটিতে সীমিত থাকেনি। বোমাবর্ষণে অনেক বেসামরিক মানুষও মারা যাচ্ছেন। অনেক স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে। ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলারও খবর আসছে। ন্যাটোভুক্ত কোনো কোনো দেশ পোল্যান্ডসহ ইউক্রেনের সীমান্তবর্তী দেশে সেনা পাঠিয়েছে। এ সংঘাত প্রলম্বিত হলে কিংবা আরও দেশের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এ পরিস্থিতিতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের উচিত অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। ইতিমধ্যে রাশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যুদ্ধবিরোধী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে শনিবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ বন্ধের যে প্রস্তাব উত্থাপন করেছিল, তা অনুমোদন পায়নি রাশিয়ার ভেটোর কারণে।

ইউক্রেনে রাশিয়ার এ সামরিক অভিযানের বিরূপ প্রভাব পড়েছে বিশ্বব্যাপী। সরবরাহও বিঘ্নিত হওয়ায় পণ্যের দাম বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো সদস্যভুক্ত দেশগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অবরোধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল, গমসহ নানা ভোগ্যপণ্য এবং সেবার দাম আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। এমনিতেই করোনা মহামারির কারণে বিশ্ববাজারে একটা অস্থিরতা চলছে। এতে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশ আরও চাপে পড়বে। অবস্থাটা এমন দাঁড়াবে যে ‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়।’

ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা বন্ধে অনেক দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান আহ্বান জানিয়েছেন। বাংলাদেশও বরাবর শান্তির পক্ষে। তাদের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি তুলে বলতে চাই, অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ হোক। সেখানকার মানুষ ও সম্পদ রক্ষা করা হোক। সেই সঙ্গে রাশিয়ার নিরাপত্তা নিয়ে কোনো হুমকি থাকলে অপনোদনে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে। পৃথিবীর ক্ষুদ্র কিংবা বৃহৎ সব দেশেরই আত্মরক্ষার অধিকার আছে।

আমরা যখন রাশিয়ার প্রতি যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছি, তখন যুক্তরাষ্ট্রসহ যেসব রাষ্ট্র প্রতিবেশী বা দূরবর্তী দেশে অন্যায্য ও অন্যায়ভাবে অভিযান চালিয়েছে, সেই ঘটনাগুলোও স্মরণে রাখতে চাই। এর পরিণতি যে ভালো হয়নি এবং বিশ্বশান্তি যে এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা রাশিয়ার বিবেচনায় নেওয়া উচিত। বিশ্বে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনতে হলে সবাইকে অপর দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান জানাতে হবে। ইউক্রেনে যেসব বাংলাদেশি আছেন, তাঁদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে সরকার কূটনৈতিক উদ্যোগ নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতি আমাদের আহ্বান থাকবে, তারা যেন বাংলাদেশসহ সব দেশের বিপদাপন্ন মানুষকে উদ্ধারে ত্বরিত পদক্ষেপ নেয়।