সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা

সম্পাদকীয়

শনিবার গণ-অনশন ও গণ-অবস্থান কর্মসূচি পালনকালে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতারা দুর্গোৎসবের সময় মন্দির-পূজামণ্ডপ ও হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে যারা হামলা চালিয়েছে, তাদের চিহ্নিত করতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছেন। যেখানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তা ও দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ এসেছে, সেখানে প্রশাসনিক তদন্ত কতটা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে, সে বিষয়ে সন্দেহমুক্ত হওয়া যাচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে ঐক্য পরিষদের দাবি অযৌক্তিক নয়।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, মন্দির ও পূজামণ্ডপে হামলার ঘটনার বিচার হবে দ্রুত বিচার আইনে। আইনমন্ত্রীর এ ঘোষণা আক্রান্ত সংখ্যালঘুদের আশ্বস্ত করবে কি না, তা নির্ভর করছে অনেক যদি ও কিন্তুর ওপর। যেকোনো মামলায় অপরাধীদের চিহ্নিত ও বিচার করার ক্ষেত্রে তদন্ত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়া জরুরি। অতীতে সংখ্যালঘুদের ওপর সংঘটিত সহিংসতার বিচার হয়নি সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা-সহিংসতার ঘটনা তদন্তে আওয়ামী লীগ সরকার একটি কমিশন গঠন করেছিল এবং তারা পর্যবেক্ষণ, সুপারিশসহ সরকারের কাছে প্রতিবেদনও জমা দেয়। কিন্তু অদ্যাবধি সেসব সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি।

আওয়ামী লীগ আমলে কক্সবাজারের রামুতে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে এবং পাবনার সাঁথিয়ায় সংঘটিত ঘটনায়ও কেউ শাস্তি পায়নি। সর্বশেষ সুনামগঞ্জের শাল্লার ঘটনায়ও অভিযুক্ত ব্যক্তিরা সবাই জামিন পেয়েছেন। অন্যদিকে ঝুমন দাশ নামে যে যুবকের ফেসবুক বার্তাকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হলো, তাঁকে সাত মাস জেল খাটতে হয়েছে। জামিনযোগ্য ধারায় মামলা হলে যেকোনো আসামি জামিন পেতে পারেন। কিন্তু তদন্ত সঠিক না হলে অপরাধীদের দায়মুক্তি পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

প্রশাসন ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা রোধে ব্যর্থ হলেও কুমিল্লা ও পীরগঞ্জের ঘটনায় এ পর্যন্ত তদন্ত যেভাবে এগিয়েছে, তা সঠিক ধারায় চলছে, এ কথা বলা অযৌক্তিক হবে না। কুমিল্লায় ইকবাল হোসেন নামে যে যুবক পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরিফ রেখে আসেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁকে গ্রেপ্তারও করেছে। গ্রেপ্তার হয়েছেন তাঁর সহযোগীরাও। অন্যদিকে পীরগঞ্জের ঘটনার হোতা বলে পরিচিত সৈকত মণ্ডল ও তাঁর সহযোগী রবিউল ইসলামও গ্রেপ্তার হয়েছেন। সৈকত মণ্ডল রংপুর কারমাইকেল কলেজের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের নেতা। ঘটনার পর ছাত্রলীগ নেতৃত্ব আগের রীতি অনুসরণ করেই তঁাকে অব্যাহতি দিয়েছে; দায় স্বীকার করেনি।

এ দুটি ঘটনায় প্রমাণিত হলো ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতারা সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতার ঘটনাকে যেভাবে সরকারবিরোধীদের কাজ বলে প্রচার চালাচ্ছেন, বাস্তবতার সঙ্গে তার মিল নেই। এই যে বারবার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটছে, তা রোধের উপায় কী। প্রথমত, অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত, দেশে এমন গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিচর্চা করা, যেখানে ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিক নির্ভয়ে নিজের মত প্রকাশ করতে পারবেন। মতপ্রকাশের দায়ে কাউকে সহিংসতার শিকার হতে হবে না কিংবা কারাগারেও যেতে হবে না। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার মতো ঘৃণ্য ও মানবতাবিরোধী অপরাধে যারা জড়িত, তাদের বিচারের আওতায় আনতেই হবে। এ ক্ষেত্রে কে কোন দল বা পক্ষের লোক, তা বিবেচনার সুযোগ নেই।