৪ জুন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোতে আগুন লেগে ৪৯ জনের প্রাণহানির পর দেশবাসী জানতে পারলেন, সেখানকার ডিপোগুলোর বিপজ্জনক পণ্য ব্যবস্থাপনা কতটা ভঙ্গুর ও অনিরাপদ। যেসব ডিপোতে বিপজ্জনক বিস্ফোরক পণ্য থাকে, সেখানে দেশীয় আইন ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকা জরুরি। অথচ ডিপোর মালিকেরা এ বিষয়ে গাফিলতি দেখিয়ে আসছেন।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে সীতাকুণ্ডের ২০টি ডিপোর মধ্যে অন্তত ১৩টি ডিপোতে ফায়ার হাইড্রেন্ট (আগুন নেভানোর পানির লাইন) না থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। নিয়ম অনুযায়ী ডিপোতে ডিজেল পাম্প স্থাপন করতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) অনুমতি নিতে হয়। অথচ ১০টি ডিপো বিপিসির অনুমতি না নিয়েই ডিজেল পাম্প স্থাপন করেছে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিয়ে। এ ছাড়া বিপজ্জনক পণ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও প্রতিটি ডিপোতেই ঘাটতি রয়েছে। ফলে দুর্ঘটনা ঘটা অস্বাভাবিক নয়।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে রপ্তানি হওয়া বিভিন্ন পণ্যের ব্যবস্থাপনার (কনটেইনারে পণ্যবোঝাই) মূল কাজটি হয় বেসরকারি ২০টি ডিপোতে। দাহ্য পদার্থ বা ঝুঁকিপূর্ণ পণ্যের মাত্রা ও মজুতের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হয়। যেসব ডিপোতে বিস্ফোরক পণ্য থাকে, সেসব ডিপোর নিরাপত্তাব্যবস্থা অনেক বেশি জোরদার করতে হয় সাধারণ ডিপোর চেয়ে। দেরিতে হলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ঘুম ভেঙেছে। বিএম ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের পর অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ফায়ার হাইড্রেন্ট বসানোর কাজ শুরু করেছে। আশা করি, এটি লোকদেখানো হবে না।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের দুটি নীতিমালায় থাকা বিভিন্ন শর্ত মানার পর কনটেইনার ডিপোগুলোকে লাইসেন্স দেওয়া হয়। বিপিসির ভাষ্য অনুযায়ী, ডিপোতে ডিজেল পাম্প বসানোর জন্য বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের কাছে কোনো ডিপো আবেদনই করেনি। তারা বিস্ফোরক অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিয়ে ডিজেল পাম্প বসিয়েছে। গত বছরের ২২ জুন বিস্ফোরক অধিদপ্তরের কাছে চিঠি দিয়ে বিপিসি অনুমোদন ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে ডিজেল পাম্প বসানোর লাইসেন্স ইস্যু না করার অনুরোধ করেছিল। কিন্তু অধিদপ্তর তা আমলে নেয়নি। এখানে সমন্বয়হীনতা স্পষ্ট।
সব মিলিয়ে কনটেইনার ডিপোগুলোর বিপজ্জনক পণ্য ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত উদ্বেগজনক অবস্থায় আছে। আমরা যদি এখনই সতর্ক না হই, ভবিষ্যতে আরও বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ও রাজস্ব বোর্ডের হিসাবে, গত অর্থবছরে রপ্তানি হওয়া ৩৮ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে সাড়ে ৩১ বিলিয়ন ডলার পণ্য রপ্তানির ব্যবস্থাপনা করছে চট্টগ্রামের ২০টি কনটেইনার ডিপো। সে ক্ষেত্রে এসব ডিপোর সার্বিক নিরাপত্তা জোরদার করার পাশাপাশি বিস্ফোরক পণ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন জরুরি। বিপজ্জনক পণ্য মজুত ও সরবরাহে দেশীয় আইন ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড রক্ষা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আইনগত কোনো ঘাটতি থাকলে, তা–ও অবিলম্বে দূর করতে হবে। বিস্ফোরক পণ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বন্দর কর্তৃপক্ষ, শুল্ক বিভাগ ও পরিবেশ অধিদপ্তরের পৃথক বিধিমালা আছে। পৃথক আইন ও বিধি কোনো কাজে দেবে না। সমন্বিত বিধিমালা করা প্রয়োজন। আর সেই বিধিমালা কেউ যাতে লঙ্ঘন করতে না পারে, সে জন্য তদারকিও জোরদার করতে হবে। এ ব্যাপারে যাতে কোনো ছাড় দেওয়া না হয়। আমরা আর কোনো প্রাণহানি চাই না।